নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
ভালো নেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ঈদুল আযহার আর মাত্র দু’একদিন বাকি থাকলেও এখনো চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিতে পারেননি তারা। ট্যানারী মালিকদের কাছে বিপুল অংকের টাকা বকেয়া, মূলধন সংকট আর ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় বিপাকে ব্যবসায়ীরা। এতে দেখা দিয়েছে কাঁচা চামড়া কেনা নিয়ে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় চামড়া নষ্ট হওয়া ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মে সীমান্ত দিয়ে চামড়া পাচারের আশংঙ্কা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
উত্তরের সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কোরবানি ঈদ উপলক্ষে এখানকার চামড়ার আড়ৎগুলোতে নেই কোন তোড়জোড়। নেই চামড়া কেনারও প্রস্তুতি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখানকার কাঁচা চামড়া তারা বিক্রি করেন নাটোর ও ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। কিন্তু, বিগত ২০১৪ সাল থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা পড়েই রয়েছে কোটি কোটি টাকা। এতে পূঁজি হারিয়ে সংকটে ব্যবসায়ীরা। সুবিধা পাচ্ছেন না ব্যাংক ঋণেরও। এ অবস্থায় এবার কাঁচা চামড়া কেনার তাই আগ্রহ নেই ব্যবসাযীদের।
চামড়া ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, এবার চামড়ার বাজার খারাপ থাকায় আমরা চামড়া কিনতে পারবো। চামড়ার গোডাউন্ড বন্ধ করে দিয়েছি। গরুর চামড়ার দাম ১০০-২০০ টাকা ও ছাগলের চামড়ার ১০-২০ টাকা দরে বিক্রয় করতে হচ্ছে। এ কারণে আমাদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। কোরবানিতে আমরা চামড়া কিভাবে সম্ভব।
চামড়া ব্যবসায়ী শাহিন বলেন, চামড়ার দামের চেয়ে লবণের দাম বেশি হওয়ায় আর ট্যানারি মালিকরা টাকা না দিলে কিভাবে চামড়া কিনা সম্ভব। আমরা ট্যানারি মালিকদের কাছে স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা এক প্রকার জিম্মি হয়েছে পড়েছে। আর আমরা চামড়া না কিনলে চামড়াগুলো কি হবে তা জানি না।
চামড়া ব্যবসায়ী মাসুম হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা চামড়ার টাকা পরিশোধ করছেনা। এবার টাকা দেবার কথা থাকলেও সেটাও করেন নি। তাহলে কিভাবে চামড়া ক্রয় করবো। তিনি আরো বলেন, ১০০-২০০ টাকা দরে বিক্রয় করতে হয় ট্যানারি মালিকদের কাছে। আর একটি চামড়া প্রস্তুত করতে খরচ হয় ২০০-২৫০ টাকা। তাহলে লোকসন দিয়ে চামড়া ক্রয় করা সম্ভব নয়।
আরেক চামড়া ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে একখন পর্যন্ত ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকা পড়ে আছে। গত বৃহস্পতিবার বকেয়া টাকা দেবার কথা ছিলো সেটাও দেয়নি। এবার ইচ্ছা পোষণ করেছি ঈদে কোন প্রকার চামড়া ক্রয় করবো না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুঞ্জুর হোসেন বলেন, ট্যানারি মালিকরা ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জেলার চামড়া ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রেখে দিয়েছেন। আর কিছু টাকা পরিশোধ করলেও ২০১৮ সাল থেকে কোন টাকা পরিশোধ করেন না। এবার আশা করেছিলাম যে ঈদের আগে ট্যানারি মালিকরা টাকা দিলে চামড়া ক্রয় করতে পারতাম। সেটাও হলো না। আর স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা কোন ব্যাংক ঋণ পান না কখন। আর আমরা এবার পূজি সংকটে পড়ে চামড়া ক্রয় করা হবে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, চামড়ার শিল্প বাচাতে বা সুদিন ফিরিয়ে আনতে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে সরকারকে। আর লবণের দামও সহনীয় রাখতে হবে। তা না হলে এ শিল্প অচিরেই ধ্বংসের মুখে পড়বে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চারটি উপজেলা সীমান্ত ঘেঁষা এবং সীমান্তের অধিকাংশই পদ্মা নদী বেষ্টিত এবং বেশিরভাগ জায়গায় কাঁটাতারের পিলার নেই, যে কারনে চামড়া পাচারের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এবার যেহেতু স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পূঁজি সংকটে চামড়া কেনার প্রতি আগ্রহ নেই সেহেতু; চামড়া পাচারের সম্ভাবনা প্রবল। ব্যবসায়ীদের দাবি এবার জেলার কোরবানির পশুর চামড়ার বেশিরভাগই দাম না পেয়ে হয় পচে নষ্ট হবে আর না হয় মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে পাচার হবে। এ অবস্থায় চামড়া সঠিকভাবে কিনতে না পারলে শুধু বড় ধরনের লোকসানই হবেনা; এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের রপ্তানিজাত এই শিল্প।
বিজিবি ৫৯’র ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর মির্জা মাঝহারুল ইসলাম বলেন, সীমান্ত দিয়ে চামড়া পাচাররোধে সকল বিওপিকে কড়া নজরদারী ও সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, অবৈধভাবে ভারতে চামড়া পাচার রোধে হেড কোয়াটারের নির্দেশে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয় করে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে। আর জেলা প্রশাসনের অধীনে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে আমরা সমন্বয় করেছি। যাতে একে অপরের সাথে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে অবৈধ পাচার কার্যক্রম আমরা রোধ করতে পারি। পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করা হয় এবং তাদের প্রেষণা প্রদান করা হয়েছে যাতে তারাও আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করে।
এদিকে, জেলা পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে কোরবানির পশুর চামড়া পাচার ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বিশেষ সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ঈদের দিন থেকে চামড়া বোঝাই কোনো ট্রাক বা পরিবহনকে সীমান্ত অভিমুখে যেতে দেয়া হবেনা।
তিনি আরো বলেন, চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ঈদের দিন চামড়া সংগ্রহের পর এক সপ্তাহের মধ্যেই এর প্রাথমিক কাজ শেষ করতে হবে ব্যবসায়ীদের। এর পর থেকে ২০ আগষ্ট থেকে ২২ আগষ্টের মধ্যে জেলার সব চামড়া ঢাকা ও নাটোরের মোকামগুলোতে পাঠিয়ে দেবেন ব্যবসায়ীরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এজেডএম নুরুল হক বলেন, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য যে লবণের প্রয়োজন হয় সেটি যদি কেউ সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায় এবং ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে গত বছরের চেয়ে জেলায় এ বছর পশু কোরবানির চাহিদা বেড়েছে।