সুরজিত সরকার
জুলাই মাস। ভ্যাপসা গরম। বৃষ্টিতে কাদায় যাতায়াত কষ্টকর হয়ে উঠেছে তার উপর দেশে চলছে করোনার ভয়বহতা যাকে আরও দূর্বিষহ করে তুলেছে বন্যা। এরমাঝে খোঁজ মেলে একই পাড়ায় দুজন প্রতিবেশির যারা জীবন যাপন করছেন আমাদের সমাজে অথচ আমাদের থেকে অনেক দূরে। তাদের নিয়েই এ আয়োজন। কেমন আছেন জাহেরা? আর কেমনই বা আছেন খলিল?
পাঠক হঠাৎ করেই দুটি নাম সামনে চলে আসলে বুঝতে পারা মুশকিল। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে যেখানে প্রতিটা মূহুর্তে দম দেয়া পুতুলের মত চলতে হচ্ছে সেখানে কি সময় আছে অজো পাড়া গাঁয়ের দুই ঘরের পাশাপাশি দুটি মানুষেরর খবর রাখার। তারপরও তো মানবতা নামের একটি বিষয় রয়েছে, যার টানে এখনও রয়েছে মানবিকতা।
জাহেরা বেগম। বয়স ৬৮। ফোলা ফোলা লাল চোখের চাহনি বাকরুদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। ছেলের ঘরের নাতনিকে নিয়ে বসবাস করছেন অন্যের দেয়া জায়গাতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে আছে পাটকাঠি আর বাঁশের বেড়ার ঘর। অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পান দাদি ও নাতনি সেটুকু দিয়েই চলেন কোন রকম। বৃদ্ধা জাহেরার চার ছেলে আর এক মেয়ে যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় বা ইচ্ছা হয়না মায়ের খবর রাখার। তারাও হয়তো দম দেয়া পুতুল হয়ে গেছে শুধু যোগ হয়েছে স্বার্থপরতা। স্বামী আব্দুল প্রাং মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। সে সময় থেকেই জাহেরার কষ্টের শুরু। জাহেরার কপালে জুটেনি কোন রকম কোন ভাতার কার্ডও। করোনার সময়ে একবার দশ কেজি চাল দেয়া হয়েছে শুধু বলে জানান জাহেরার নাতনি বিউটি খাতুন (২৭)। বিউটি জাহেরার মেজ ছেলের মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর দাদির সংসারে এসে উঠেছেন সৎ মায়ের সংসারে জায়গা না পেয়ে। বিউটির একটি মেয়েওে আছে। সব মিলে জাহেরার সংসারে তিন জন সদস্য হলেও আরও একজন আছে যার নাম টানাপোড়েন।
পাঠক এবারে একটু ভিন্ন রকম ভাবে পরিচয় করিয়ে দিই খলিলের সঙ্গে। কবির সুমনের পাগল গানটি অনেকেই হয়ত শুনেছেন। পাগল, সাপ লুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে/চালচুলো নেই তার, নেই তার চেনা বা অচেনা… খলিলুর রহমান এমনই একজন মানুষ যার কোন সম্পর্ক নেই সমাজের সঙ্গে। খলিলের সংসার বলতে রয়েছে একচালা টিন আর দেয়াল বলতে কয়েকটি বাঁশ। মেঝের মধ্যের ভাঙ্গা চৌকি পরিণত হয়েছে পাটাতনে।
গ্রামের লোকের অভিযোগ খলিলকে কেউ কিছু দিলে নাকি সে বিক্রি করে দেয়। পাশেই ভায়ের ঘর থেকে খাবার দিলেও নাকি সে খায়না। মানসিকভাবে অসুস্থ্য খলিল এ দাবি খোদ এলাকাবাসীর। তবে একটি মানুষ যদি মানসিকভাবে অসুস্থ্যও হয়ে থাকে তাহলে তার দেখভালের কি কোন ব্যবস্থা সমাজের নেই।
খলিলের ঘরে দেয়াল ছাড়া জানালা আছে যেটি দিয়ে আলো বাতাস বৃষ্টি আসার জন্য অনেক জায়গা রয়েছে শুধু ঢুকতে পারেনা মানবতা। খলিলের অপ্রস্তুত চাহনি কিংবা পাটাতনে পরে থাকা কম্বল সবকিছু এড়িয়ে যায় সবার দৃষ্টি থেকে। সকলের কানে মনে বাজে শান্তনার দোহাই ওতো পাগল। পাগলের কি এসমাজে বাঁচার কোন অধিকার নেই। জাহেরা ও খলিলেরা সব জায়গাতেই থাকে।
শুধু দেখার জন্য একটু সময় আর মন লাগে তাদের ভালোবাসার। তবুও যদি কেউ খোঁজ করতে চান জাহেরা আর খলিলের তবে যেতে পারেন নলডাঙ্গার বিপ্রবেলঘরিয়া ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের বানুরভাগ গ্রামে। জাহেরা ও খলিল প্রতিবেশি। পঞ্চাশ হাত দূরত্বে দুটি দুই বয়সের মানুষ নির্মম সংগ্রাম করছেন, জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত খেলে যাচ্ছেন সাপলুডু। সে খেলা দেখে যাচ্ছেন বিধাতা। বিধাতার এ পরীক্ষা কাদের নিচ্ছেন সেটি কি জানে এ সমাজ। হয়ত কোন দিন কোন এক সময় মারা যাবেন জাহেরা-খলিল। তখন হয়ত আমাদের জন্য বলতে সুবিধা হবে, আহা! বড় কষ্টে ছিল। মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে।