শেখর কুমার সান্যাল
স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমসাময়িক দুই কীর্তিমান পুরুষ। তাদের জন্ম উত্তর কলকাতায় মাত্র বছর দেড়েকের ব্যবধানে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে জোড়াসাঁকোয়, বিবেকানন্দের (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) জন্ম সিমলায় ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি। দুজনের বেড়ে ওঠা কাছাকাছি পাড়ায়, অথচ দুজনের জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘকাল গবেষকদের ধারণা ছিল তাঁদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ এমন কি আলাপ পরিচয়ও ছিল না। এরূপ ধারণার পিছনে প্রধান কারণ ছিল, ধর্মবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। পরবর্তী গবেষণায় এ ভ্রান্তির নিরসন হয়। মতান্তর সত্ত্বেও তাঁদের নৈকট্য হয়েছে অনেক সময়েই। প্রথমে বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণভাবাদর্শে সম্পৃক্ত হওয়ার পূর্ব পর্বে এবং উত্তরকালে ভগিনী নিবেদিতার যোগসূত্রে।
ড. কালিদাস নাগের ‘বিবেকানন্দ-জীবনীর উপাদন সংগ্রহ’ থেকে জানা যায় ১৮৮১ সালে ২৯ জুলাই রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর সঙ্গে ময়মনসিংহের গুরুচরণ মিত্রের পুত্র কৃষ্ণকুমারের বিবাহসভায় সাধারণ ব্রহ্মসমাজ মন্দিরে রবীন্দ্রনাথের লেখা এবং শেখানো গান গেয়েছিলেন নগেন চট্টোপাধ্যায়, ডা. সুন্দরীমোহন দাশ, কেদারনাথ মিত্র, অন্ধগায়ক চুনীলাল এবং নরেন্দ্রনাথ দত্ত(পরবর্তীকালের বিবেকানন্দ)। অল্প বয়স থেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এবং ব্রহ্মসমাজে নরেন্দ্রনাথের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এবং যৌবনে তিনি রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গান নিয়মিত গাইতেন। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থে তার উল্লেখ আছে। ১৮৮৭ সালের আগস্ট মাসে বৈষ্ণবচরণ বসাক ও নরেন্দ্রনাথ দত্ত যৌথভাবে ‘সংগীতকল্পতরু’ নামে একটি সংগীতসংগ্রহ সম্পাদনা করেন। এই সংকলনে যুবক রবীন্দ্রনাথের ১২টি গান অন্তর্ভুক্ত ছিল; ১০টি গান রবীন্দ্রনাথের নামে, একটি ভানুসিংহ ছদ্মনামে এবং একটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে(ভুলক্রমে!)।
বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে ছিল বিপুল পার্থক্য। প্রথম নিরাকার-সাকারের অনৈক্য। সাকারসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শে দীক্ষিত বিবেকানন্দের সাথে রবীন্দ্রনাথের নিরাকারবাদী ব্রাহ্মবিশ্বাসের ছিল অসেতুসাধ্য যোজন দূরত্ব। ঠাকুর পরিবারের পরিশীলিত আভিজাত্য ও পাশ্চাত্য-শিক্ষিত বৈদগ্ধ্য স্বামীজীকে প্রভাবিত করত না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে দেখিয়েছেন তথাকথিত আচরণের শালীনতা বা ভাষার ভাবরীতির সঙ্গে ধর্মের নিত্যসম্পর্ক নেই। বিবেকানন্দের ভারত-জাগরণ মন্ত্র রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রেত হলেও তাঁর দেশপ্রেমের আগ্রাসী মানসিকতাকে সমর্থন করা শান্তরসের সাধক রবীন্দ্রনাথের সম্ভব ছিল না। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে উপন্যাসে আলোচনায় প্রধর্ষী দেশপ্রমকে কখনো স্বীকৃতি দিতে পারেন নি।
ভারতবর্ষের নবজাগরণের কাজে স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদুষী আইরিশ লেখিকা-শিক্ষিকা মার্গারেট এলিজেবেথ নোবেল ১৮৯৮ সালের ২৯ জুলাই ভারতে আসেন এবং ২৫শে মার্চ ভারতীয় সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ে অভিষিক্ত প্রথম পাশ্চাত্য মহিলা হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা নিয়ে হলেন ‘নিবেদিতা’, আমৃত্যু নিবেদিত রইলেন ভারতবাসীর স্বার্থে। ক্রমে নিবেদিতা হয়ে ওঠেন ভারতবাসীর পরমাত্মীয় আপনজন। অল্পদিনের মধ্যেই কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে তাঁর পরিচয় এবং ঘনিষ্টতা হয়। এঁদের অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে নিবেদিতা বাগবাজার এলাকায় একটি বালিকা বিদ্যালয় খুলে মৌলিক শিক্ষাবঞ্চিত কন্যাশিশুদের শিক্ষায় ব্রতী হন। নিবেদিতা প্রতি বৃহস্পতিবারে ব্রাহ্মসমাজে ‘শিক্ষা’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতেন। সেখানে উপস্থিত থাকতেন কেশবচন্দ্রের কন্যা সুনীতিদেবী ও সুচারুদেবী, রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবী ও ভাগিনেয়ী সরলা ঘোষাল, জগদীশচন্দ্রের ভগিনী লাবণ্যপ্রভা বসু প্রমুখ শিক্ষিতা ব্রাহ্ম মহিলারা, যাঁরা স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা স্বর্ণকুমারীদেবী ও জানকী ঘোষালের কন্যা, রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন সরলাদেবীর ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদিকা হিসেবে শিক্ষিতসমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা ছিল। স্বামী বিবেকানন্দের সাথেও তাঁর ভালো পরিচয় ছিল। ‘ভারতী’ পত্রিকার ১৩০৩ চৈত্র সংখ্যায় ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ প্রবন্ধের শেষার্ধে ‘নিরাশা’ প্রকাশ এবং ১৩০৪ বৈশাখ সংখ্যায় তা প্রত্যাহারে সূত্রে এই মহিলার অকপট ভাষণ ও তেজস্বিতায় মুগ্ধ বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল তাঁকে লিখেছিলেন, “যদি আপনার ন্যায় তেজস্বিনী বিদুষী বেদান্তজ্ঞা কেউ এই সময় ইংলন্ডে যান, আমি নিশ্চিত বলিতেছে, এক এক বৎসরে অন্ততঃ দশ হাজার নরনারী ভারতের ধর্ম গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ হইবে। … যদি আপনার ন্যায় কেউ যান তো ইংল্যান্ড তোলপাড় হইয়া যাইতে পারে, আমেরিকার কা কথা”। এরপর কর্মব্যস্ততায় তাঁদের যোগাযোগ শিথিল হয়ে যায়।
রামকৃষ্ণ-ভাবান্দোলনের সাথে আদি ব্রাহ্মসমাজের আদর্শগত বিরোধ থাকলেও ব্রাহ্মসমাজের অনেকের সাথে, বিশেষত ঠাকুর পরিবারের অনেকের সাথে নিবেদিতা ক্রমশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠতে লাগলেন, বিশেষভাবে বললে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
ব্রাহ্মসমাজের সাথে সখ্যতা গড়ার পেছনে নিবেদিতার অন্যতম উদেশ্য ছিল দেশীয় সমাজে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রভাব ছড়াতে ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি যুবসমাজকে প্রভাবিত করা। স্বামীজীর এতে সমর্থন ছিল। সে সময় শিক্ষিত সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রাহ্ম-মনোভাবাপন্ন। রবীন্দ্রনাথ তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক। নিবেদিতা চাইছেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ-অনুরাগীদের সেতু-বন্ধন। নিবেদিতার উদ্যোগ সার্থক হলে বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্র মসৃণ হতে পারত।
ভারতের বিশ্বনন্দিত সমসাময়িক দুই প্রবাদপুরুষ বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের মানসিক ব্যবধান কমিয়ে আনতে বিবেকানন্দ-শিষ্যা ভারতপ্রেমিক ভগিনী নিবেদিতা প্রয়াসী হয়েছিলেন। যদিও নিজ নিজ মতবাদ ও জীবনবোধে অনড় এই দুই প্রতিভার মনোভাব পরস্পরের প্রতি ছিল যথেষ্ট শীতল।
১৮৯৯ সালের ২৮শে জানুয়ারি নিবেদিতা স্বামীজির আগ্রহে বাগবাজারে ১৬ বোসপাড়া লেনে তাঁর স্কুলবাড়ির খোলা উঠোনে ব্রাহ্ম বন্ধুদের জন্য এক ঘরোয়া চা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন। স্বামীজি সেখানে আসবেন এবং কথা বলবেন এটা আগেই ঠিক করা ছিল। সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু, সস্ত্রীক ড. প্রসন্নকুমার রায়, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সরলা ঘোষাল, তাঁর মা স্বর্ণকুমারীদেবী এবং রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন চা-পানের আসরে। ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারকে সঙ্গে নিয়ে যোগ দিলেন স্বামীজি। ঘরোয়া আলাপচারিতার পরিবেশে নিবেদিতা মুখোমুখি আনতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গাওয়া তিনটি গানের মৃদু সুরের আবহ সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে ১৮৯৯ সালের ৩০ জানুয়ারি নিবেদিতা লেখেন, ‘মি. টেগোর তাঁহার মনোরম চড়া পুরুষালি কন্ঠে নিজের তিনটি গান পরিবেশন করিলেন। প্রতিবেশীর বাড়িগুলি হইতে সন্ধ্যারতি ও ঘন্টার ধ্বনি শোনা যাইতেছে। এই সময়কে এখানকার মানুষেরা সেঁজুতি বলে। I cannot forget the lovely poem ‘Come O’ Peace’(এসো শান্তি) – সঙ্গে তাঁহার সকরুণ মৃদু সুরের আবহ। এবং স্বামীজি ছিলেন অনবদ্য। তবে there was some cloud.’। সেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছিল কি না এ সম্বন্ধে ইতিহাস নিশ্চুপ।
১৪ ফেব্রুয়ারি নিবেদিতা জোড়াসাঁকোয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন এবং স্বামীজির ভাবধারার প্রতি তাঁকে সদয় করতে চেষ্টা করেন। স্বামীজির বার্তাবাহী হিসেবেই তিনি মহর্ষি-দর্শনে গিয়েছিলেন। মহর্ষি তাঁকে জানান, স্বামীজি অল্প বয়সে একবার তাঁর কাছে এসেছিলেন এবং এখন আবার একবার এলে তাঁর ভালো লাগবে। অবস্থা অনুকূল বিবেচনা করে নিবেদিতা তাঁদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। স্বামীজি ইতিমধ্যে ব্রাহ্মদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তবে মহর্ষির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে তিনি আগ্রহী ছিলেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি স্বামীজি নিবেদিতাকে সাথে নিয়ে জোড়াসাঁকোয় যান। মহর্ষিকে প্রণাম করে একটি গোলাপের তোড়া নিবেদন করেন। মহর্ষি আশীর্বাদ করে তাঁদের বসতে বলেন। তিনি প্রায় দশ মিনিট বাংলায় বিবেকানন্দকে কিছু কিছু বিষয়ে অভিযুক্ত করেন। কথা শেষ হলে স্বামীজি বিনীতভাবে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। মহর্ষি তাঁকে আশীর্বাদ করেন। মহর্ষিকে পুনরায় প্রণাম করে তাঁরা নিচতলায় নেমে আসেন। ইন্দিরাদেবী এবং ঠাকুর পরিবারের আরো কয়েকজন সেখানে ছিলেন স্বামীজির সাথে দেখা করতে। মহর্ষির সাথে দেখা করতে আগ্রহী হলেও ঠাকুর পরিবারের অন্যদের সাথে আলাপচারিতায় স্বামীজির বিশেষ আগ্রহ ছিল না। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে।
এত উদ্যোগ-আয়োজনেও বিবেকানন্দ ও ঠাকুরবাড়ির সম্পর্কের বরফ গলে নি। বরং কঠোর হাতে স্বামীজী নিবেদিতা রাশ টানতে চাইলেন। ১৮৯৯ সালের ১১ই মার্চ স্বামীজী তাকে সতর্ক করে বলেন, “তুমি যতদিন ওই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা চালিয়ে যাবে আমাকে বারবার সাবধান করেই যেতে হবে। মনে রেখো, ওই পরিবার বঙ্গদেশকে শৃঙ্গাররসের বন্যায় বিষাক্ত করছে”।
ঠাকুর পরিবারের সাথে নিবেদিতার অতিরিক্ত ঘনিষ্টতায় স্বামীজী বিরূপতা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তা করতে গিয়ে রবীন্দ্রকাব্যকে সরাসরি আক্রমণ করার পেছনে বিশেষ কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি পাওয়া যায় না। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, বিবেকানন্দ যৌবনে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন এবং বৈষ্ণবচরণ বসাকের সঙ্গে ‘সঙ্গীতকল্পতরু’ গ্রন্থ সংকলনকালে রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি গান অন্তর্ভুক্ত করেন। এগুলি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সে লেখা। রবিজীবনীকার অধ্যাপক প্রশান্তকুমার পালের মতে “বিবেকানন্দের দুর্ভাগ্য, তিনি রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কবিতা ও গদ্যরচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। থাকলে এরূপ উক্তি করতে তিনি অবশ্যই দ্বিধাগ্রস্ত হতেন”। রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের প্রতি মনোযোগী থাকার মতো আগ্রহ বা অবসর কোনোটিই তাঁর ছিল না। হয়তো রবীন্দ্র-অনুসরণকারী ব্যর্থ কবিদলের প্রতিই তিনি আঘাত করেছেন। বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ কবি পরিচয় সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার কথা নয়। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখেছেন, একুশ বছর বয়সে বিবেকানন্দ যখন রামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে উপনীত তখন চব্বিশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ‘বালক’ পত্রিকা পরিচালনা করছেন। ‘কড়ি ও কোমলে’র রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের জীবদ্দশাতেই ‘নৈবেদ্য’ পর্যন্ত এগিয়েছেন। কয়েক বছর আগে ‘কথা ও কাহিনী’র বরণীয় ত্যাগের মহিমা-বাণী উচ্চারিত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহৎ রাজপথের এই পরিব্রাজক সে সবের পরিচয় রাখতে পেরেছিলেন কি না সন্দেহ। ‘গীতাঞ্জলি’ পর্ব তো স্বামীজীর তিরোধানের (৪ জুলাই ১৯০২) অনেক পরের বিষয়।
বিবেকানন্দের দেহাবসানের পর তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনোভাবের কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই ‘এক্সেলসর ইউনিয়ন’ ভবানীপুর সাউথ সুবার্বন স্কুলে স্বামীজীর স্মৃতিতে যে শোকসভার আয়োজন করে সেই সভার মূল বক্তা ছিলেন নিবেদিতা এবং সভাপতি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ শুধু বিবেকানন্দের শক্তির অসামান্যতা বিষয়েই অবহিত ছিলেন তাই নয়, স্বামীজির চিত্তের সঙ্গতিও তিনি অনুভব করেছিলেন বলেই স্বামীজির স্মৃতিসভায় সভাপতিত্ব করতে সম্মত হয়েছিলেন। তিনি নিবেদিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েও থাকতে পারেন। মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন, ‘এ অনুমান করা হয়তো অসঙ্গত নয় যে বিবেকানন্দ যদি অত অল্প বয়সে না মারা যেতেন, তাঁর জীবন যদি আরও বহুতর কর্মের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হতে থাকত তাহলে ক্রমে তাঁরা নিশ্চয়ই নিকটে আসতেন যেমন এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ। উভয়ের মতানৈক্য তো উভয়েই প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু সে মতের অনৈক্য মাত্র, তার বেশি নয়’।
স্বামীজির মূল্যায়ন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতামত পরবর্তীকালে আর পুরানো বিরাগে আচ্ছন্ন তো থাকেই নি, বরং যথাযথ শ্রদ্ধাবোধে উজ্জ্বল। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে ছাত্রসমাজের সামনে ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ নামে তিনি একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধটি ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকায় একযোগে ভাদ্র ১৩১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন, “অল্পদিন পূর্বে বাংলাদেশে যে মহাত্মার মৃত্যু হইয়াছে, সেই বিবেকানন্দও পূর্ব ও পশ্চিমকে দক্ষিণ ও বামে রাখিয়া মাঝখানে দাঁড়াইতে পারিয়াছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে পাশ্চাত্যকে অস্বীকার করিয়া ভারতবর্ষকে সংকীর্ণ সংস্কারের মধ্যে চিরকালের জন্য সংকুচিত করা তাঁহার জীবনের উপদেশ নহে। গ্রহণ করিবার, মিলন করিবার, সৃজন করিবার প্রতিভাই তাঁহার ছিল। তিনি ভারতবর্ষের সাধনাকে পশ্চিমে এবং পশ্চিমের সাধনাকে ভারতবর্ষে দিবার ও লইবার পথ রচনার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন”।
এই প্রবন্ধের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ নামে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ১৩১৫ ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্ট, “ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অধুনাতন মনীষিগণ একথা বুঝিয়াছিলেন, তাই তাঁহারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলাইয়া কার্য করিয়া গিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ রামমোহন রায়, রানাডে এবং বিবেকানন্দের নাম করিতে পারি”।
সহায়ক পাঠ-‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ – এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ – দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত।
লেখক: শেখর কুমার সান্যাল, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার