রেজাউল করিম খান:
মুক্তিযুদ্ধের এতোদিন পর এই প্রশ্ন এখন আর কেউ করে না। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধের আদ্যপান্ত জানতে চান, যাদের কৌতূহল আছে, এই লেখা তাদের জন্য। আমরা জানি, ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের পর পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত সিএসপি ও ইপিসিএস কর্মকর্তাগণ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, এখন তারা কী করবেন? ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর কতিপয় বাঙালি অফিসার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। কিন্তু ওই রাতে বঙ্গবন্ধু আটক হওয়ার পর তারাও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। ফলে অধিকাংশ অফিসার নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করলেন, কিছু সংখ্যক অনিচ্ছা সত্বেও সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আর কয়েকজন আগরতলায় চলে যান।
পরে অনেকের লেখা থেকে জানা যায়, দেশ ত্যাগ করতে তাঁদের খুবই কষ্ট হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইজিপি আব্দুল খালেক ১৯৮৪ সালে এক জবানিতে বলেন,
“আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও আইন পরিষদের সদস্যগণ কোনো কেন্দ্রীয নির্দেশে দেশত্যাগ করেন নি। তাঁদের কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না। যাঁরা আগরতলায় গিয়েছিলেন, তাঁদের সাথে কোলকাতায় অবস্থানরতদের দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না।”
পরে অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাসহ সকলে একত্রিত হন। কিন্তু এদিকে অধিকাংশ সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসার পাকিস্তান সরকারে অধীনে কাজে যোগ দেন। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার সদস্যগণ শপথ গ্রহণ করেন। এরপর অনিবার্য কারণেই অস্থায়ী সরকারের কার্যালয় কলকাতায় স্থানান্তরিত হয। তবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে এবং এর নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে, জোন, যুব শিবির বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অনেক সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসাররাও যুক্ত ছিলেন। আমাদের আলোচ্য সিভিল সার্ভিস অফিসারদের মধ্যে এদের ভূমিকাই সবচেয়ে উজ্জ্বল ও কীর্তিময়। ভিনদেশে প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের দুইটি ধারা সূচিত হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রশাসন সংগঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আওতায় আনা হয়।
মাহবুব আলম চাষী, হোসেন তৌফিক ইমাম, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক কাঠামো বানানোর চেষ্টা করেন। পরে কলকাতা কেন্দ্রিক প্রশাসনের অর্ন্তভুক্ত হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধগুলি ছিল অনেকটাই পরিকল্পনাহীন। পরে ধীরে ধীরে কমান্ডের অধীনে আসে। ১১ জুলাই বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড তৈরি হয়। কর্ণেল এম.এ.জি ওসমানীকে কমান্ডার ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আব্দুর রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ ও চিফ অব এয়ার ফোর্স-এর দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য ছাড়াও অধিকাংশ ইপিআর ও পুলিশকে নিয়মিত বাহিনীর অধীনে রাখা হয়। ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা বাহিনী অনেকটা স্বাধীনভাবে স্থানীয়দের নিয়ে অভিযান পরিচালনা করত। গেরিলাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল পাকিস্তানী সেনাদের ক্যাম্প, সামরিক স্থাপনা, রেল, সড়ক, ব্রিজ, রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতা।মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান (একাত্তরে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক) লিখেছেন, “মুজিবনগর সরকারের প্রধান দুইটি কাজ ছিল; এক, যুদ্ধ করা; দুই, শরণার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এই সাহায্য ছিল প্রধানত ভারতীয়। কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পগুলি ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। ওই সময় নিজেদের শুধুমাত্র সরকারি চাকুরে বলে কথনও মনে হয়নি। আমরা ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের এক একটি অংশ। কোনো কষ্টই বড় ছিল না। কোনো ত্যাগের প্রশ্নে ছিল না দ্বিধা। কখনও ভাবিনি আমাদের কি হবে। একটা কথাই কেবল মনে হতো, কাজটা যে করেই হোক সমাধা করতে হবে। তার জন্য যা করার দরকার সবই করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম।”
হোসেন তৌফিক ইমাম সিএসপি একাত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক ছিলেন। এপ্রিল মাসে প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দেন। পরে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নেন। সঙ্গে নেন জেলা ট্রেজারির ২ কোটি টাকা। পরে সেই টাকা বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে জমা দেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এরপর মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে মন্ত্রী পরিষদ সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৯৬৯ সালের সিএসপি সা’দত হুসাইন লিখেছেন, “জুলাই মাসে সিলেটের জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ মুজিবনগর পৌঁছান। ক্লান্ত, অবসন্ন ও কয়েকদিনের অভুক্ত। তিনি সর্বজ্যেষ্ঠ অফিসার। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে প্রতিরক্ষা সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়।”
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ অফিসার রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী লিখেছেন, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার সম্বন্ধীয় নীতি নির্ধারণী সভা ৩রা সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে সভাপতিত্ব করেন প্রতিরক্ষা সচিব আব্দুস সামাদ।” ওই বেতার কেন্দ্রটি ছিল মুক্তিযোদ্ধা তথা বাঙালিদের প্রেরণা।