ডাঃ মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
থ্যালাসেমিয়া একটি মারাত্মক রোগ হলেও সহজে প্রতিরোধযোগ্য। এটি একটি বংশগত রোগ হওয়ায় বাবা-মা দুজনেই এই রোগের বাহক হলে সন্তানও আক্রান্ত হতে পারে। আর এ কারণে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষ নিজের অজান্তে হয়ে উঠছেন এ রোগের বাহক, শিশুরা বংশগতভাবে তাদের পিতা- মাতা থেকে পেয়ে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত চাচাত ভাই- বোনদের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানদের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই রোগীদের রক্তের লাল কণিকা( RBC) তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে তাদের রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে এবং আয়রণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই কারণে এদেরকে ২০ থেকে ৩০ দিন পর পর রক্ত দিতে হয় এবং শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রণ বের করার জন্য ঔষধ খেতে হয়।
খুব ছোট শিশুদের মধ্যে রক্তশূণ্যতা, জ্বর, শারীরিক বৃদ্ধি না হওয়া, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখে থ্যালাসেমিয়া রোগ সন্দেহ করেন এবং রক্তের বিশেষ মাইক্রোস্কোপিক
পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হন। যেহেতু এই রোগের চিকিৎসায় প্রচুর টাকা খরচ হয়, সেহেতু মধ্যবিও বা দরিদ্ররা এই রোগে আক্রান্ত হলে ভিখারী হতে বেশী সময় লাগে না। এতো পয়সা খরচ করেও এসব শিশুদেরকে সাধারণত বিশ- এিশ বছরের বেশী বাচাঁনো যায় না।
ধ্বংসপ্রাপ্ত লাল কণিকা থেকে নির্গত আয়রণ লিভার, হৎপিন্ড এবং পেনক্রিয়াসে জমা হতে থাকে এবং শরীরের অতিরিক্ত আয়রণের বিষক্রিয়ায় এসব রোগী লিভার সিরোসিস, হার্ট ফেইলিওর, প্লীহা বড় হওয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয় এবং এদের শরীরে যৌবনের আগমণ ঘটে বিলম্বে আর এদের শারীরিক বৃদ্ধিও তেমন একটা ঘটেনা।
বর্তমানে থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা “অ্যানিমিয়া”তে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানিও ঘটতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা- মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।
থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়াবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
বিশ্বে বেটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনও কখনও ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর এটি একটি মারাক্তক জেনিটিক ডিজিজ বিধায় খুব একটা নিরাময় হয় না বলে সবাই বিশ্বাস করত। তবে ইদানীং বিভিন্ন দেশের অনেক হোমিওবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অগণিত থ্যালাসিমিয়া রোগীকে সমপুর্ণরূপে আরোগ্য করার দাবী করেছেন যাদের ডিসচার্জ করার পর পাচঁ ছয় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
হোমিও স্পেশালিষ্টদের মতে, শতকরা ৫০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগীকে হোমিওচিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি রোগ মুক্ত করা সম্ভব। আর অবশিষ্ট থ্যালাসেমিয়া রোগীরা সম্পূর্ণ রোগমুক্ত না হলেও হোমিওচিকিৎসায় তাদের অবস্থা এতটাই উন্নত হয় যে, অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নিলে মাসে বা বছরে একবার রক্ত নিলেই চলে। হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিতে মনো-দৈহিক গঠনগত চিকিৎসা কন্সটিটিউশনাল নামে এক ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত আছে যার অর্থ হলো রোগের লক্ষণ, রোগীর শারীরিক লক্ষণ, রোগীর মানসিক লক্ষণ, রোগীর বংশগত রোগের ইতিহাস ইত্যাদি বিচার করে ঔষধ নির্বাচন করা। এতে চিকিৎসক একজন রোগীর পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয় এবং তাকে অনেক চিন্তা- ভাবনা করতে হয়।
হোমিওপ্যাথির দুইশ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে যে, এমন সব কঠিন রোগও খুব সহজে নিরাময় হয়ে যায়, যা অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে একেবারে অবিশ্বাস্য মনে করা হয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়া থেকে মুক্তির জন্য একজন হোমিও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো চলা উচিত, যিনি রোগীর শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক লক্ষণ বিবেচনা করে সঠিক ঔষধ নির্বাচন করে থাকে। কিন্ত দুঃখের বিষয়, ইদানিং কিছু কিছু হোমিও চিকিৎসক, রোগীর লক্ষণ নির্বাচন না করে, থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে পেটেন্ট, টনিক দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। ঐসব ডাক্তার বাবুদেরকে ডাঃ হ্যানিম্যান বলে থাকেন “শংকর জাতের হোমিওপ্যাথ”।
হোমিওপ্রতিবিধানঃ
রোগ নয় রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এই জন্য অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকগণ যেই সব ঔষধ ব্যবহার করে থাকেন, সিয়ানোথাস, এসিড সালফ, ফেরাম মেট, আর্সেনিক এল্বাম, অ্যান্ড্রাগ্রাফিস, চায়না, কার্ডুয়াস মেরী, ক্যালকেরিয়া ফ্লোর, ইউক্যালিপটাস, আলফালফা, থুজা, মেডোরিনামসহ আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে। সাবধান অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক ছাড়া ঔষধ নিজে নিজে ব্যাবহার করলে রোগ আরও জটিল আকারে পৌঁছাতে পারে।
লেখক:
ডাঃ মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
বিশেষজ্ঞ, হোমিও গবেষক ও জটিল রোগীর চিকিৎসক
ই-মেইলঃ [email protected]
মোবাইলঃ ০১৮২২৮৬৯৩৮৯