কবিঃ সেলিম রেজা নিউটন
কবিতাঃ জেলের গোলাপ
?
জেলের গোলাপ নিয়ে একদিন ঘরে ফিরে যাব।
তোমাকে বলব: ‘জানো, বন্দিশালাতেও
কয়েদিরা বান্ধবকে বকুলের মালা গেঁথে উপহার দেয়–
তাতে থাকে গোলাপ-লকেট।’
অনেক চুলের নিচে কানে গুঁজে পাখির পালক
আমার পাখির কাছে একদিন ফিরে যাব ঠিক।
আমাদের অন্তরের যুগলকুসুম থেকে প্রস্ফূটিত পাখিকে বলব:
‘পাখির বাচ্চাও আসে কারাগার-করিডোরে–
বাবা-পাখি তার মুখে দানা তুলে দেয়।’
উন্নত প্রাচীর গেঁথে প্রাণের প্রবাহ কেউ পারে না ঠেকাতে।
প্রবল প্রাকারে বন্দি বিল্লিরও ছানা ফোটে–
মিয়াঁও মিয়াঁও বলে মায়ের নরম কোলে জীবনের উষ্ণ ওম চায়।
চায় শান্তি, চায় খাদ্য, চায় মুক্তি – ওম মুক্তি!
কর্তাদের কোনো ছায়া সূর্যের সন্তাপ ঢেকে রাখতে পারে না।
এমন কয়েদখানা কোনোখানে নেই যার গরাদের জোরে
বন্দির বন্ধুত্ব কেউ কেড়ে নিতে পারে।
মানুষের বোঝাপড়া, ভালোবাসা, দেয়া-নেয়া, পরামর্শ-শলা,
জীবের বেদনা, গান, বাকস্ফূর্তি, দুঃখ-হর্ষ, প্রাণের প্রকাশ–
বহু কাল হলো সব কয়েদ খাটছে এই বিমর্ষ জগতে।
মানুষের বাচ্চারা বড় হয়ে মানুষই থাকলে
ভব-পারাবার থেকে কারাগার একদিন ক্ষয়ে যাবে কালের অতলে।
তার আগে আমরা এই জেলে
বসে বসে চঞ্চল ও মানিকের ‘আর্যজন ও সিন্ধুসভ্যতা’ নিয়ে তর্ক করে যাব।
হরপ্পা দেখে নি জেল, কেননা হরপ্পা-দেশে মেথর ছিল না–
মানুষের মলমূত্র মানুষ মাথায় বয়ে গড়ে নি ভাগাড় চারিধারে।
লোথাল, মহেঞ্জোদারো, রাখিগাড়ি, ধোলাভিরা, আল্লাদিনোতে
– সিন্ধু-সরস্বতী-কূলে, সভ্যতার সেই শিশুকালে –
সমমনা ঘর ছিল, পর্ণকুটিরের পাশে ছিল না প্রাসাদ।
শিশুর হাসির আলো অবাধ, অখিল।
পাখির আকাশ খোলা – মুক্তপক্ষ – নীল।
মানুষ নদীর মতো– বহতা সলিল।
তারপরও বাঁধ পাতে দেও-দানো, বেদে আছে, সিন্ধু-সরস্বতী-পাড়ে আমরা দেখেছি;
রামগড়ুরের পিতা বৃথা-কাণ্ডে টেপ মারে শিশুর অধরে মিছামিছি;
কর্তৃত্বের কারিগর উঁচু করে খাঁচা গড়ে– চেষ্টা করে আকাশের চেয়ে আরও উঁচু!
রতনে রতন চেনে, শূকরেরা কর্দমাক্ত কচু।
শূকরের জন্য যেটা সত্য সেটা মানুষের জন্য মিথ্যা, তাতে সর্বনাশ–
নদীতে বানালে বাঁধ হরপ্পা নিহত হয়। লুপ্ত হলে মানবীয় স্বভাবের ঘাস
বাঁধ হাসে, বাঁধানো সড়ক হাসে– মুছে যায় পথের ইশারা।
বড়ই বৃক্ষের নব-শাখে তাই হররোজ নয়া ফুল, নতুন বিন্যাস;
নক্ষত্রের আলো মাখা বেদনার গন্ধ শিখে মাটিকে প্রণতি করে প্রতিদিন ব্যথার বকুল;
গবাক্ষ-গরাদে বসে গায়েবের গান গায় আত্মকর্তা স্বাধীন শালিক।
জীবনের, সমাজের, মঙ্গলের অধিক সঙ্গত সুর অর্জনের দায়
নিখিলের নীতি হয়ে, নতুনের নিষ্ঠা হয়ে, অনন্তের আত্মা হয়ে আকুল আনন্দে
মহাবিশ্ব-মালিকের সার্বভৌম নিয়মের জারি করে বিচিত্র চেহারা।
স্বভাবের স্বনিয়মে– স্বাধীন সম্বন্ধে
বাচ্চাকাচ্চা খেলা করে, বড় হয়, ঢিল ছোঁড়ে ট্যাঙ্কের চূড়ায়।
নতুনের নবগন্ধে বৃদ্ধ হয় মহামান্য কর্তার ঝিলিক।
লকাপ খোলারও আগে প্রতিদিন ভোরে
উঁকি দিয়ে দেখি আমি বারো-হাত-দেয়ালের নিচে
শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু হয়ে ফুটছে কিনা মুক্তির স্বচ্ছতা।
জেলের মুয়াজ্জিন রতনের স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে গেছে কথা–
কারাগ্রাম-প্রান্তে ঐ প্রাচীন বকুলতলে চলিতেছে মুক্তিমালা গাঁথা।
তমসার তেপান্তর পাড়ি নতুন সকাল তবে দেখা দেবে নাকি!
তাই কি গোলাপ ফোটে কয়েদির শ্রমে সাধা বাগানের সবুজ বেড়ায়?
জেলের গোলাপ নিয়ে একদিন যাব তোর কাছে–
বলব, দ্যাখ্ অপেক্ষায় প্রেম কত রক্তিম হয়েছে!
?
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার:
৮ই আশ্বিন ১৪১৪
২৩শে সেপ্টেম্বর ২০০৭