নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনাঃ
চিংড়ি পোনার তীব্র সংকটে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কায় খুলনাঞ্চলের চাষীরা চলতি বছর চিংড়ি পোনার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মৌসুমের শুরু থেকেই নেই পর্যাপ্ত পোনা সরবরাহ। যা এখনো অব্যহত রয়েছে। বেশিরভাগ চাষীরা এখনো চাহিদার অর্ধেক পোনা ঘেরে মজুদ করতে পারেননি।
অপরদিকে ২০ মে থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মা চিংড়ি আহরণের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকায় পোনা উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন পোনা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায়ের চাষীরা। ফলে এ বছর চরম পোনা সংকটের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি চাষীরা ব্যাপক লোকসানের আশংকা করছেন। এ অবস্থায় করোনা পরবর্তী সংকট মোকাবেলায় দেশের দক্ষিনাঞ্চলের সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মা চিংড়ি আহরণের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জুলাই পরবর্তী কার্যকর করা অথবা নূন্যতম এ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়াসহ সরকার ঘোষিত প্রনোদনা পোনা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান, চিংড়ি রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান ও চাষীদের মধ্যে সুষম বন্টনের দাবী জানিয়েছে শ্রীম্প হ্যাচারী এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং দক্ষিণাঞ্চলের পোনা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান এবং চাষীরা।
সুত্রমতে-দেশের অন্যতম রপ্তানীকারক পণ্যের মধ্যে চিংড়ি অন্যতম। যা দেশের দক্ষিণ উপকুলীয় অঞ্চলে বেশিরভাগ উৎপাদন হয়ে থাকে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের উর্বর ভূমি হচ্ছে চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। দেড় লাখেরও বেশি হেক্টর জমিতে এ অঞ্চলে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। আশি’র দশকে শুরু হওয়া চিংড়ি চাষ অত্যান্ত লাভজনক হলেও এ শিল্পে এখন টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে সকলের। বিশেষ করে ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুই দশক চিংড়ি চাষীরা একটা অজানা আশংকার মধ্যে অবস্থান করছে। এরপর এ বছর দেখা দিয়েছে পোনা সংকট। মৌসুমের শুরু থেকেই এখনো অব্যহত রয়েছে পোনা সংকট। সাগরে মা চিংড়ি সংকটের কারণে পোনা উৎপাদনও কমে গেছে বলে হ্যাচারী এ্যাসোসিয়েশন দাবী করেছে। পাশাপাশি গত কয়েকবছরের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে চলতি চিংড়ি মৌসুমে দক্ষিনাঞ্চলের বেশিরভাগ চাষীরা চাহিদার অর্ধেক পোনাও এখনো ঘেরে মজুদ করতে পারেনি।
সবুজ মৎস্য খামারের পরিচালক ইসতিয়ার রহমান শুভ বলেন, বর্তমানে চিংড়ি উৎপাদনের উপযোগী সময় অতিবাহিত হচ্ছে, এই সময় চিংড়ি দ্রুত বেড়ে ওঠে। চিংড়ি পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময় চলে যাচ্ছে। অথচ চাহিদার অর্ধেক পোনাও এখনো ঘেরে মজুদ করতে পারিনি। ফলে এ বছর চিংড়ির উৎপাদন অনেক কম হবে বলে ধারণা করছি। খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট চিংড়ি চাষী গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, গত ১০/১৫ বছরের মধ্যে পোনার এমন সংকট দেখা যায়নি। দেশের চাহিদার সিংহভাগ পোনা কক্সবাজার থেকেই সররবরাহ করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি দক্ষিনাঞ্চলে পোনা উৎপাদনের জন্য ২০ টি হ্যাচারী ছিল। যার অনেকগুলোই ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে সাগরে প্রাকৃতিকভাবে মা চিংড়ির সংকট দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পোনা উৎপাদন থেকে সরবরাহে। শুধুমাত্র সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণ উপকুলীয় অঞ্চলের জন্য প্রতিদিন পোনার চাহিদা রয়েছে নুন্যতম ৬ কোটি। অথচ চাহিদার স্থলে সরবরাহ মিলছে ১ থেকে দেড় কোটি। এখনো পর্যন্ত পোনা ঘাটতি রয়েছে। চিংড়ি চাষী হিসেবে এ বছর ব্যাপক লোকসানের আশংকায় তিনি সাগরে মা চিংড়ি সংকটের কারণ নির্ণয় ও সাগরে অবস্থান নির্ণয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন।
শ্রীম্প হ্যাচারী এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেব) এর মহাসচিব নজিবুল ইসলাম জানান, পোনা সংকটের অন্যতম কারন মা চিংড়ির সংকট। তিনি বলেন, কক্সবাজারে ৫০টি পোনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০ টি হ্যচারী চালু রয়েছে। দীর্ঘদিন লোকসানের কারনে ২০টি হ্যাচারী ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো যেগুলো চালু রয়েছে মা চিংড়ির অভাবের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নজিবুল ইসলাম বলেন, আগে যেখানে ১০০ টির মধ্যে ৩০ টিতে মা চিংড়িতে ডিম পেতাম। এখন সেখানে ১০ থেকে ১৫ টিতে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। সারা বছর দেশে ৯শ থেকে ১ হাজার কোটি চিংড়ি পোনার চাহিদা রয়েছে। মৌসুম শেষে সর্বোচ্চ হয়তো ৫ শ কোটি পোনা উৎপাদনে আসতে পারে। এরপরও চাহিদার অর্ধেক পোনা সংকট থেকে যাচ্ছে। এ কারনে পোনা উৎপাদনকারী ও চিংড়ি চাষীদের এ বছর ব্যাপক লোকসানের সম্মুখিন হতে হবে।
হ্যাচারী এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব বলেন, করোনার কারনে সরকার বাঁধাগ্রস্থ না করলেও পরিবহন বন্ধ থাকায় সরবরাহ স্বাভাবিকভাবেই বাধাগ্রস্থ হয়েছে। চাষীরা অনেকেই পোনা কিনতে পারেনি। এরমধ্যে ২০ মে থেকে মা চিংড়ি আহরণের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়েই পোনা উৎপাদনকারি ও চাষীদের জন্য চরম সংকট তৈরী হচ্ছে। তিনি বলেন, মা চিংড়ি যেসময় আহরণ বন্ধ করা হয়েছে। এটি চিংড়ি চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী সময়। এটা পেছানোর জন্য সরকারকে বলা হয়েছে। সরকার টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছে। পরীক্ষা নীরিক্ষার নাম করে ইতোমধ্যে ৪ বছর অতিবাহিত হয়েছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবছর মা চিংড়ি আহরণের উপর সরকারি যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা এখনই প্রত্যাহার করা উচিত। পাশাপাশি সরকারিভাবে যে প্রনোদনা দেয়া হবে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় অথচ লোকসান গুনতে হয় পোনা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায়ের চাষীদের। প্রনোদনার অর্থ পোনা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান, রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান ও চাষীদের মধ্যে সমানভাবে বন্টনের দাবী চিংড়ি সংশ্লিষ্ট সকলের।