মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশের গর্ব। তাঁর অপরিসীম জ্ঞান এবং আন্তরিকতা দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিশেষ অবদান রেখেছে। তিনি পরমাণু বিজ্ঞানকে দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী বিজ্ঞানী এবং দেশের আণবিক পাওয়ার প্ল্যান্টের স্বপ্নদ্রষ্টা।
বিজ্ঞাপন
ক্ষমতার ভেতরে থেকেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহারের সামান্যতম সুযোগ নেননি ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। তিনি আপন অবস্থানে থেকেই কাজ করে গেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের রূপপুরে একটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা, দেশের বিজ্ঞানীদের পেশাগত কাজের উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ করা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, তিনি তাঁর ইচ্ছার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।
দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রসারে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি শুধু একজন মেধাবী ছাত্র বা পরমাণু বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, নীতিবান, নিরহঙ্কার, নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, সৎ, সহজ-সরল, বিনয়ী, চরিত্রবান, যুক্তিবাদী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর প্রতিভার অনেক দিকই আমাদের অজানা।
বিজ্ঞাপন
১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাঁকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। সেই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-৭৩ ও ১৯৮৩ সালে ওই গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। আবার ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। এসব আমরা অনেকেই জানিনা।
১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি পর পর দু’বার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পর পর তিনবার বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতিরি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ দুই বছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি এসব পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন শুধু তাঁর যোগ্যতার নিরিখেই।
অগণতান্ত্রিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কিছুদিন কারাবরণও করেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পর পর দু’বার বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পর পর দুবার দুই বছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১- ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন।
এছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পর পর তিনবার তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন। এসব তালিকাক্রম থেকেই অনুমেয় যে তিনি কতখানি খাঁটি বিজ্ঞানী ছিলেন।
আমরা এই বিজ্ঞানীকে ততটা সম্মানিত করতে পারিনি, যতটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আমাদের গর্বের ধন। আগামী প্রজন্মের মনে বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়িয়ে দিতে এই বিজ্ঞানীর প্রবন্ধ-নিবন্ধ, জীবনী-কর্মকান্ড, প্রচার-প্রসার অধিকহারে পঠিত হওয়া জরুরি প্রয়োজন। ২০০৯ সালের এই দিনে ৬৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
লেখক: সিনিয়র সচিব, গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রণালয়