আজ ২৪ এপ্রিল আমার মা সবিতা চক্রবর্ত্তীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী।
নাটোরের কাফুরিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবার লাহিড়ী বাড়িতে ১৯২৭ সনে সবিতা লাহিড়ী নামে যে মেয়েটি জন্মেছিল, সময়ান্তরে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার বৃহত্তর বালুভরা অঞ্চলে এসে তিনি হয়ে গেলেন সবিতা চক্রবর্ত্তী।
বিদূষী ও মমতাময়ী এ নারী আমার মা। মানুষ হিসাবে তিনি মনুষ্যত্ব ও মহত্বের যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা কখনই ভোলার নয়। এলাকায় শিক্ষা-সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সমাজ কল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সেজন্য নওগাঁ এলাকায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
১৯৪৭ সনে দেশভাগের পর আমাদের গ্রামের অনেক হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করলেও মা-বাবা দেশ মাতৃকার টানে রয়ে গেলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সপরিবারে শরণার্থী হয়ে হাজার হাজার মানুষের সাথে ভারতের পশ্চিমববঙ্গের বালুর ঘাটের কুরমাইল-কামার পাড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করি (তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি)। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন কলকাতাসহ অন্যান্য জায়গায় ছিলেন। কিন্তু মা’র একই কথা আমরা শরণার্থী হিসাবে থাকব, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশেই চলে যাব। তবুও কোনো আত্মীয় স্বজনের গলগ্রহ হতে চাই না। কি আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তাঁর।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমরা সপরিবারে বাংলাদেশে ফিরলাম। কিন্তু আমাদের ঘর-বাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়েছিল, ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করেছিল। যাচ্ছে তাই অবস্থা। বাবা মা এলাকাবাসীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করলেন। সে মোতাবেক আমরা আমাদের স্কুলের (বালুভরা আর,বি উচ্চ বিদ্যালয়- আমার পিতামহ উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন ১৯১৪-১৯৪৫ পর্যন্ত) হেড মাস্টার সাহেবের দালান ঘরের দুটি কক্ষে আমরা কয়েক মাস বাস করি। অন্যান্য বেশ কিছু পরিবার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা মাটির ঘরগুলিতে বসবাস করেছিল। কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের জন্মভিটায় মা-বাবা কোনমতে বসাবাস করার মত ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করেন স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতায়। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু মায়ের দৃষ্টি আমাদের স্কুলের প্রতি। কেননা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ছেলে-মেয়েরা যাতে নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্ট করেন।
এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নিয়ে ঘন ঘন মিটিং সিটিং করে স্কুলের শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজে অবহেলিত মানুষদের জন্য কিছু করা, এ যেন নিত্যদিনের কাজ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জীবনে একটা বড় স্বপ্ন ছিল বালুভরা আর,বি, উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি সুন্দর গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করার। ছেলে মেয়েরা যাতে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে, সৎ গুণাবলী অর্জন করতে পারে মানুষের মত মানুষ হয়ে যাতে দেশ ও দশের সেবা করতে পারে , সেজন্য আজীবন পরিশ্রম করে গেছেন।
শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতির লালন ও বিস্তারের জন্য গ্রন্থাগার চিরদিনই আমাদের একক ও সমষ্টিগত জীবনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠা করা হয় সবিতা চক্রবর্তী গ্রন্থাগার। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যাঁরা দেশ বিদেশে অর্থাৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁদের ছবি এই গ্রন্থাগারের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে (প্রায় চারশ)। যা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং গভীর আগ্রহের সৃষ্টি করে। প্রচুর পরিমাণে বই-পুস্তক রয়েছে এই গ্রন্থাগারে। সুবিশাল পরিসরে গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা এবং জ্ঞান পিপাসুরা যাতে জ্ঞানার্জন ও বিদ্যাচর্চা করতে পারে সেই রকম আগ্রহ আমার মায়ের মনে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছিল। মফস্বলের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের গ্রন্থাগার বিরল। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক জ্ঞান-পিপাসু মানুষ/শিক্ষার্থী গ্রন্থাগার দর্শনে আসে। সাংস্কৃতিক আড্ডা, পারস্পরিক মতবিনিময় এবং পাঠাভ্যাস কমায় ক্রমেই অনুভূতিহীন এক যান্ত্রিক সমাজ তৈরি হচ্ছে। অসহিষ্ণু হচ্ছে মানুষ। এছাড়া সাহিত্যে আবহমান কালের সম্প্রীতি. প্রান্তিক জীবনাচার এবং লোকজ ঐতিহ্য তুলে না ধরলে শেকড়হীন বৃক্ষে পরিণত হবে নবীন প্রজন্ম। মায়ের এই রকম চিন্তা ছিল শিক্ষার্থীরা জ্ঞান, চিন্তায়, চেতনায়, মানসিকতায়, শিক্ষায়, সভ্যতায়, চেতনায়, বিবেচনাবোধে, পরিমিতিবোধে সচেতন হয় এবং নবীন প্রজন্ম যাতে এসবের চর্চা করতে পারে, নিজেদের ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে। এক কথায় বটবৃক্ষের ন্যায় গ্রন্থাগারের ছায়ায় তা যাতে করতে পারে সেজন্য এই আয়োজন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক সর্বজন শ্রদ্ধেয় শশীভূষণ চক্রবর্ত্তীর স্মৃতিকে ধরে রাখার মানসে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর যেমন প্রতিষ্ঠাতার স্মরণে শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘শশীভূষণ মেধা বৃত্তি’ প্রদান করে থাকে। ঠিক তেমনই বৃহত্তর বালুভরা অঞ্চলে শিক্ষা সংস্কৃতি, ক্রীড়া, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন সেজন্য আমাদের অঞ্চলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই বিদূষী নারীকে স্মরণ করেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বৃহত্তর বালুভরা বাসীর দাবী ও ঐকান্তিক আগ্রহেই এ প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিটি ‘সবিতা চক্রবর্ত্তী স্মৃতি গ্রন্থাগার’ নামকরণ হয়।
আজকে আমাদের সমাজে মূল্যবোধ চরম নৈতিক অবক্ষয় ও সংকটে আক্রান্ত। আজকে প্রয়োজন প্রত্যেক পরিবারে আমার মায়ের মত সৎ, নিষ্ঠাবান, নৈতিক সাহসী মানুষ; যাতে সমাজটা বদলে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এই সোনার বাংলায় আমরা যাতে নিরাপত্তা, সুখ, শান্তি ও স্বস্তিতে বসবাস করতে পারি।