প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসে সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলা নববর্ষ ১৪২৭-এর প্রাক্কালে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সকলকে সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। সরকার সব সময় আপনাদের পাশে আছে। আপনারা ভয় পাবেন না। ভয় মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে।’
ভাষণের শুরুতে তিনি দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বিভিন্ন বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও রেডিও সরাসরি সম্প্রচার করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অতীতে নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঙালি জাতি সাহসের সঙ্গে সেগুলো মোকাবেলা করেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিজয়ী জাতি আমরা। বাঙালি বীরের জাতি। আমরা সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাসজনিত মহামারি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ।’ তিনি আতঙ্ক না ছড়াতে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না। কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এ সংকটকালে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। মিডিয়াকর্মীদের প্রতি অনুরোধ, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক তথ্য তুলে ধরে এই মহামারি মোকাবেলা করতে আমাদের সহায়তা করুন।’
সামনের কাতারে থেকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাওয়া চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে দেশবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পেশাটাই এ রকম চ্যালেঞ্জের। এই ক্রান্তিকালে মনোবল হারাবেন না। গোটা দেশবাসী আপনাদের পাশে রয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীগণ সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে একেবারে সামনের কাতারে থেকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের পেশাটাই এ রকম চ্যালেঞ্জের। আমি দেশবাসীর পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমা বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ : প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানী দিতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেসব সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন, ইতোমধ্যে তাঁদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তাঁদের বিশেষ সম্মানী দেওয়া হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনরত সবার জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীর জন্য বীমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমা বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বীমা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭৫০ কোটি টাকা।’
সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি নেই : করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি নেই জানিয়ে চিকিৎসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সুরক্ষা সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি নেই। নিজেকে সুরক্ষিত রেখে স্বাস্থ্যকর্মীগণ সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাবেন—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। একই সঙ্গে সাধারণ রোগীরা যাতে কোনোভাবেই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হন, সেদিকে নজর রাখার জন্য আমি প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে নিয়োজিত পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী আনা-নেওয়ার কাজে এবং মৃত ব্যক্তির দাফন ও সত্কারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরাসহ জরুরি সেবা কাজে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
এবার ঘরে বসে নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন : করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ঘরের বাইরে নববর্ষের সব অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার কথা পুনরুল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘরে বসে নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন, পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করুন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতিটি বাঙালি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করে থাকেন এই উৎসব। এ বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পহেলা বৈশাখের বহিরাঙ্গনের সকল অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে। কারণ ইতোমধ্যে এই ভাইরাস আমাদের দেশেও ভয়াল থাবা বসাতে শুরু করেছে।
এর আগে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও জনসমাগম এড়িয়ে রেডিও, টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সম্প্রচার করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানও আমরা একইভাবে উদ্যাপন করব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ঘরে বসেই এবারের নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করব। কবিগুরুর কালজয়ী গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ গেয়ে আহ্বান করব নতুন বছরকে। অতীতের সকল জঞ্জাল-গ্লানি ধুয়ে-মুছে আমরা সামনে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাব; গড়ব আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।”
আঁধার ভেদ করে বেরিয়ে আসতে হবে নতুন দিনের সূর্যালোকে : শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের যে গভীর আঁধার আমাদের বিশ্বকে গ্রাস করেছে, সে আঁধার ভেদ করে বেরিয়ে আসতে হবে নতুন দিনের সূর্যালোকে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় বলতে চাই : মেঘ দেখ কেউ করিসনে ভয়/আড়ালে তার সূর্য হাসে/হারা শশীর হারা হাসি/অন্ধকারেই ফিরে আসে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশে এবং প্রবাসে বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ আনন্দঘন পরিবেশে উদ্যাপন করে থাকেন। রাজধানীতে রমনা পার্ক, চারুকলা চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ নগরীর নানা স্থান মানুষের ভিড়ে মুখরিত থাকে এদিনটি। গ্রামীণ মেলা, হালখাতাসহ নানা অনুষ্ঠানে গোটা দেশ মেতে ওঠে।’
কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজসহ নানা মৌসুমি ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসে নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন : ‘এবার সবাইকে অনুরোধ করব কাঁচা আম, জাম, পেয়ারা, তরমুজসহ নানা মৌসুমি ফল সংগ্রহ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে বসে নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করুন। আপনারা বিনা কারণে ঘরের বাইরে যাবেন না। অযথা কোথাও ভিড় করবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন, পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করুন।’