রবিবার , নভেম্বর ১৭ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / গুজবের স্কুল বন্ধ করা দরকার

গুজবের স্কুল বন্ধ করা দরকার

রেজা সেলিম

ইংরেজীতে যাকে ‘রিউমার’ বলা হয় তা হলো উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা তথ্য ছড়ানো। আর ‘গসিপ’ বলা হয় যা অলস মস্তিষ্কের অলস আলোচনা, তা সরস বা নিরস যাই-ই হোক। এই দুয়ে মিলে বাংলাদেশে তৈরি করা হয়েছে একটি নতুন স্কুল, যাকে আমরা ‘গুজব’ নামে জানি। কেউ কেউ বলেন, ‘আজগুবি’ কথাই ‘গুজব’, যা আগে কখনও শোনা যায়নি, যা সত্য দিয়ে মেশানো মিথ্যা।

আমরা সবচেয়ে বেশি অবাক হই, যখন দেখি এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী তাদের ধর্মে নিষিদ্ধ এই কাজে নিজেদের লিপ্ত করে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে তোমরা গোপন করো না’ [সুরা বাকারা ২:৪২]। অথচ আমরা দেখছি এই ধর্মের লেবাসধারীদের ক্রমাগত মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রচারে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। ইউটিউবে যা দেখা যায় তাতে অবাক হতে হয় বাংলা ভাষায় এসব কুতর্ক, অসত্য ও মিথ্যার সক্রিয় মিশ্রণ আমাদের মাতৃভাষাকে কিভাবে বিকৃত করে চলেছে। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে এদের এই মিথ্যাচার যেন সর্বকালের সকল কুতর্কের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে এক শ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত অলস মস্তিষ্কের মানুষ যারা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে নানারকমের মিথ্যা, অপপ্রচার ও গুজবের আশ্রয় নেয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে এমন উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার ও গুজবের প্রতিরোধ করে করেই কাজ করতে হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম কিছু ঘটনা তখন ঘটেছিল। সাজানো ডাকাতির ঘটনায় গুজব রটিয়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরা ফেলা থেকে শুরু করে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেয়ার অসংখ্য মিথ্যা গল্প তখন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে এদেশকে বানানো হয়েছিল মিথ্যা ইতিহাসের দেশ! উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজবের গল্প বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করা হয়েছে। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ সেসব গুজব ও মিথ্যা তথ্য-সন্ত্রাসের যথাযথ জবাব দিয়ে ইতিহাসকে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে, কিন্তু সেসব মিথ্যা বানানোর চক্র বংশ-পরম্পরায় এখনও সক্রিয় আছে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় ধর্মকে পুঁজি করে এসব চক্র কেমন করে এসব কাজ করে? এরা কি আসলেই দেশ ও মানুষের মঙ্গলাকাক্সক্ষী?

এসব হীনম্মন্য মানুষের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গত জানুয়ারি থেকে দুনিয়াজুড়ে চলছে এক সংক্রামক রোগের সঙ্গে মানব বিজ্ঞান ও সভ্যতার লড়াই। প্রকৃতি ও সময় মানুষকে এনে ফেলে দিয়েছে এক কঠিন পরীক্ষায়। এই করোনাভাইরাস এমনই এক রোগ যার গতি প্রকৃতি বুঝতে জীববিজ্ঞানের বিদ্যমান যুক্তির হিসেবও মিলছে না। ফলে দেশে দেশে এই ভাইরাসের প্রকৃতি নির্ণয় যেমন চলছে, তেমনই চলছে এর থেকে মানবদেহকে মুক্ত রাখার কৌশল আবিষ্কারের গবেষণা কাজের অদম্য প্রচেষ্টা। এসব মূলধারার কাজের উদ্যোগে অক্ষম ও অলস মানুষগুলো কোনরকম যুক্তির ধারে কাছেও যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না। ফলে ঘরে বসে তাদের মিথ্যা চিন্তার জগতে ঠাঁই নিয়েছে অসত্যের আঁধার। এদের কেউ কেউ ধর্ম, অধর্ম, যুক্তি ও গায়ের জোর এক করে দেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করেই চলেছে। কিছু অনলাইন পত্র-পত্রিকা, ফেসবুক, ইউটিউব-সহ জানা অজানা মাধ্যমে এরা ক্রমাগত মিথ্যা ছড়াচ্ছে, যা মূলত দেশের সরলপ্রাণ মানুষকে ভুল ধারণায় রেখে নিজেদের উদ্দেশ্য আদায় করা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি দৈনিক পত্রিকায় এমন কিছু বিবরণ ছাপা হয়েছে যা পড়লে শিউরে উঠতে হয়। এসব গুজব ও মিথ্যা ছড়াতে এদের কৌশল এতই নিখুঁত যে, এদের উপস্থাপনা দেখে যে কেউ এমনকি শিক্ষিত, নামী-দামী মানুষও বিশ্বাস করে বসবেন। যেমন, কেউ একজন লিখেছে যে, স্থানীয় পুলিশ তার এক আত্মীয়ের কাছে দু’লাখ টাকা চেয়েছে, যদি না দেয়া হয় তো সে আত্মীয়ের বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দেবে! কখনও কখনও পুলিশের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ আসে। কিন্তু এরকম সময়ে এই জাতীয় অভিযোগের কোনই ভিত্তি নেই। কারণ লাল পতাকা টানাবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে। তারা চিকিৎসকের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্ত নেবেন, পুলিশ শুধু তাদের সাহায্য করবে। যাচাই করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে, কিন্তু সাধারণ মানুষ কাহাতক এসব জ্বালাতন সহ্য করবে?

কেউ একজন ফেসবুকে লিখে দিলেন করোনাভাইরাসের আক্রমণে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশে ২০ লাখ মানুষ মারা যাবে! ইতোমধ্যে কয়েক হাজার মানুষ নাকি মরেও গেছে! আর সরকার এসব তথ্য গোপন করছে! অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে এ জাতীয় গুজব ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ২০১৩ সালের মে মাসে দেশ-বিদেশে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছিল যে, হেফাজতে ইসলামের সমর্থক আড়াই হাজার মানুষকে নাকি মতিঝিলে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। যদিও যারা এসব অভিযোগ করেছিল তারা কেউই আজও পর্যন্ত তা প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের কোন তালিকাও দিতে পারেনি। আবার কেউ কেউ সেসময়ে ভুল বলেছিল এই বলে পরবর্তীতে ক্ষমাও চেয়েছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী দেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তার সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মোট ৩৭টি নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনাগুলো ভাল করে না পড়ে বা না বুঝেই এর খ- খ- তথ্য নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ ক্রমাগত মিথ্যাচার করেই চলেছে। তারা যা বলছে সরকারী পদক্ষেপে বা নির্দেশনায় সেসবের লেশমাত্র নেই। কিন্তু বাক্যজালে এমনভাবে সেগুলো উপস্থাপনা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষ সেগুলো হয় বিশ্বাস করছে বা সরকারের উদ্দেশে দুর্বলতা খুঁজে পাচ্ছে। বলা বাহুল্য, মিথ্যা বা গুজব ছড়ানো মানুষগুলোর লক্ষ্য সেটাই, যেন মানুষ এমন দুর্দিনে সরকারের প্রতি আস্থা হারায়।

আমাদের বুঝতে হবে এই গুজব রটনাকারী কারা! সরকারের ও দেশের সচেতন মানুষের সে সক্ষমতা আছে যাতে এদের চিহ্নিত করা যায়। এখন আমাদের কর্তব্য হবে জনসমক্ষে তাদের সচিত্র হাজির করা বা তাদের নাম-ধাম-পরিচয় প্রকাশ করে দেয়া। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে এক চিকিৎসক অনেক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার সামনে মারা যাচ্ছে এমন মিথ্যা ছড়িয়ে পরে গ্রেফতার হলেন। জানা গেল তিনি মৃত মানুষজনের কোন নাম ধামই জানাতে পারেননি ও স্বীকার করেছেন যে, ইচ্ছা করেই তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি আবার একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মীও বটে! এর অর্থ হলো, এসব রটনাকারী মানুষগুলোর পরিচয় একটাই- তারা মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণকারী। সরকারের ভাবমূর্তি হরণ, সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে উত্তেজিত করে ’৭৩-৭৪ সালের কায়দায় একটি পরিস্থিতি তৈরি করা এবং দেশের ইতিহাসকে কলঙ্কযুক্ত করে রাখাই এদের মূল উদ্দেশ্য। এরা ধর্মের নামে বেসাতি করে কিন্তু ধর্ম মানে না। যেসব ধর্মধারীরা অবান্তর বা গাঁজাখুরি কথা আওড়ান, আমাদের উচিত এদের সমূলে নির্মূল করা।

এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান কাজ হবে, ‘তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হবো না কেন’ এই সত্য অনুসরণ করে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের দেয়া নিয়মাবলী সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা। করোনা নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে ভয়ঙ্কর যেসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, সেসব গুজব সম্পর্কে সচেতন করে আসল তথ্য জানানোর পথ তৈরি করা। নিজেকে সুস্থ রেখে পরিবার ও আশপাশের লোকজনকে সুস্থ রাখার পরিবেশ তৈরি করে সরকারী নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা। সামনে আমাদের জন্যে সুদিন আসবেই। আরও ভাল করে এসব মিথ্যা ও গুজবওয়ালাদের আমরা ধরতে পারব। যেহেতু সে সক্ষমতা আমাদের আছে, একটা হুঁশিয়ারি তাদের আমরা আপাতত দিয়েই রাখতে পারি। আর যেসব তথাকথিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ওয়াচ টাইপ সংস্থা এসব নিয়ে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয় আর বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশটাকে খাটো করে রাখতে যারা এই দেশে বসে সেসব সংস্থার তাবেদারি করে, তাদেরও আমাদের চিনে রাখা দরকার। আর যাদের মানসিক চিকিৎসা দরকার, তাদের জন্যে আমরা সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে একটা আদর্শ শিক্ষার স্কুল করে দেব, সে পরিকল্পনাও আমাদের করা থাকল।

লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়ন

গবেষণা প্রকল্প

আরও দেখুন

পিরোজপুরে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ে দিনব্যাপীপ্রশিক্ষণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক:  ১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ঢাকা: মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ে পিরোজপুরের …