ড. মাহবুবা নাসরীন
মুজিব শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে ১০ মার্চ পালিত হচ্ছে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। তাঁর জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে এ দিবসের তাৎপর্য এ বছরকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে পরপর দুই মাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ছিল ২৮ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচনের আগে বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর রাজনৈতিক ভাষণ। অন্যটি ছিল ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার কবিতার যে অমর পঙ্ক্তিমালা তিনি গেঁথেছিলেন, তার আগের ১৯৭০ সালের এই দুটি ভাষণও বাঙালিদের উজ্জীবিত করেছিল স্বৈরাচারী শাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
বঙ্গবন্ধু প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেন, সে সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণের জীবনযাত্রা একই রকম ছিল না। পশ্চিমের জনগণের ওপর মুদ্রাস্টম্ফীতির প্রভাব পড়েনি; কিন্তু পূর্বের খেটে খাওয়া, শোষণ-বঞ্চনার শিকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্বাচনী ভাষণে পাট, তুলাসহ বিভিন্ন অর্থকরী ফসল, ভূমি ব্যবস্থা, কৃষকের ঋণ মওকুফ, বনজ ফল, পশু ও মৎস্যসম্পদ চাষের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক মৌলিক ভিত্তির প্রথম তিনটি স্তম্ভকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে প্রথমেই ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ। তিনি একটি সুসংহত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কথা বলেছিলেন; যা আমরা পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন কর্মসূচিতে লক্ষ্য করি। জলাবদ্ধতা দূর করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কথা বলেছেন। আরও কয়েকটি বিষয়ে স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলেন তা হলো, যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন।
দরিদ্র জনগণ বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে এবং দরিদ্র কৃষকদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে, তা বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কৃষিব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থার বিষয়টি ছিল তাঁর ভাষণে। ফারাক্কা বাঁধ যে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভয়ংকর ও স্থায়ী সর্বনাশ করেছে, বঙ্গবন্ধু তা মোকাবিলার জন্য অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘রাজনৈতিক সম্প্রচার’ পর্বে তিনি বাংলার জনগণের জন্য দিয়েছেন সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা। যার অন্যতম কৃষক ও দরিদ্র জনগণের মুখে হাসি ফোটানো; যা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত দুর্যোগকবলিত জনগণের রক্ষাকবচ টিকে থাকার অবলম্বন।
২৮ অক্টোবরের নির্বাচনী ভাষণ বাংলার জনগণের মাঝে তুলেছিল তুমুল আলোড়ন। ১২ নভেম্বর যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, তার ওপর তিনি আবারও বেতার-টেলিভিশনে ভাষণ দেন। নির্বাচনী প্রচার বন্ধ করে বাংলার দুর্যোগকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি চালিয়ে যান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এই মহান নেতা। ২৬ নভেম্বর দেওয়া ভাষণের মাঝে ছিল আজকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তুলে আনা দুর্যোগাক্রান্ত জনগণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন। সে বছর নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনায় এই চারটি জেলা সফর করে তিনি ১০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানির কথা ও উপদ্রুত এলাকার বেঁচে থাকা জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরেন।
পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারের চরম ব্যর্থতার উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার দু’দিন আগে সুপারকো ও আবহাওয়া উপগ্রহের মধ্যে খবর পাওয়া সত্ত্বেও উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের যথাযথভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়নি। হতভাগ্যদের কিছু লোককে অন্তত অন্য স্থানে সরানোর কোনো প্রকার চেষ্টা করা হয়নি।’ উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সরকারের অদূরদর্শিতা ও বৈরী মনোভাব বর্ণনার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য দুর্যোগের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন- ‘আজাদীর ২৩ বছর পরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এমনকি পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ১০ বছর আগেও একবার ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে এই এলাকার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এবার ১০ বছর পর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা সহস্র গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দশক আগে ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী আশ্রয়স্থল নির্মাণ, সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রামসমূহের পুনর্বিন্যাস এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। পূর্ণ এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এসব পরিকল্পনা একগাদা প্রকল্পের মধ্যে আটকা পড়ে আছে এবং তা এখনও কার্যকর করা হয়নি।’ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রকৃতির ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচাতে হলে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই অর্জন করতে হবে। তাহলেই আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের পুনর্বাসন, গ্রাম পুনর্গঠন যে কোনো জরুরি সমস্যার সমাধান করতে পারব।
আজকের বাংলাদেশ দুর্যোগ, বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। জাতির পিতার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরিকল্পনার পেছনে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। দুর্যোগাক্রান্ত জনগণের মাঝে ত্রাণসামগ্রীর অপ্রতুলতা, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ না থাকা, আশ্রয়স্থলের অভাব, ফসল, গবাদি পশুর মড়ক আর বেঁচে থাকা মানুষগুলোর চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কষ্ট তিনি সরেজমিন দেখে এগুলোর দ্রুত প্রতিকার চেয়েছিলেন। তার বক্তৃতায় ছিল পাকিস্তান সরকারের প্রতি কঠোর সমালোচনা- ‘আমলাদের যদি কোনো সরকারের কাছে নিজেদের কাজকর্মের কৈফিয়ত দিতে হতো, তাহলে তারা এত উদাসীন হতে সাহস পেত না।’
দেশবাসীকে আর একটি ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করতে হলে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, তা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলেছিলেন :উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণি প্রতিরোধী পর্যাপ্ত আশ্রয়স্থল নির্মাণ, সুষ্ঠু বিপদ সংকেত ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য চেয়েছিলেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা, গবাদি পশু, উন্নত লাঙল, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ দুর্যোগ-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া। এই ভাষণের সর্বশেষ অংশ বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত মানুষের পাশে সরকার থাকুক এবং পরবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে তিনি বলেছিলেন- ‘আর যদি নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়, তাহলে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ লোক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্য আমরা যাতে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে পারি তার জন্য, আমরা যাতে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হতে পারি তার জন্য, প্রয়োজনবোধে আরও ১০ লাখ বাঙালি প্রাণ দেবে।’ ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ৯ ডিসেম্বরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে যে ভাষণ দেন, সেখানেও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ লোক নিহত ও ৩০ লাখ বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-সংগ্রামে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবকে তিনি নিজেদের জন্য পাহাড়সম কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
বঙ্গবন্ধু ওই ভাষণের পরদিনই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো উপকূলীয় অঞ্চলে ছুটে যান ও দুর্গত মানুষদের সঙ্গে ত্রাণ তৎপরতায় নেতৃত্ব দেন। নৌকায় চড়ে ও হেঁটে দুর্গম এলাকার প্রান্ত থেকে প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়ে তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অসংখ্য সভায় উজ্জীবিত ভাষণ দিয়েছেন। সন্দ্বীপে একটি জনাকীর্ণ সভায় তিনি দুর্যোগকবলিত জনগণের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষার সংকল্পের অবিচলতার প্রমাণ দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেওয়া, ঋণ নয় বরং তাদের জন্য অর্থ, হালচাষের গরু, বীজ, গৃহনির্মাণ সামগ্রীসহ সব প্রয়োজনীয় জিনিস বিনামূল্যে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ত্রাণ তৎপরতার কোনো রকম অনিয়মের ছাড় দেওয়া হবে না বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে যে ৩৫টি নির্দেশনা দেন, তার মধ্যে ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় বাঁধ তৈরিসহ সব উন্নয়নমূলক কাজ, সাহায্য-সহযোগিতা, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন।
দুর্যোগকবলিত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করার চারিত্রিক এই বৈশিষ্ট্য বঙ্গবন্ধুর স্কুল ছাত্রজীবন থেকেই শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দুর্দশা দেখে তাঁর কিশোর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে। নিজ ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন- ‘এই সময় শহীদ সাহেব লঙরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃষ্ঠা ১৮)। দক্ষিণ বাংলার দুর্দশাপীড়িত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতার জন্য তিনি ঢাকা থেকে কলকাতার বড় বড় নেতার কাছে গেছেন একটি কনফারেন্সের আয়োজনের মাধ্যমে অনাহারী জনগণের মুখে হাসি ফোটাতে আর তাদের উজ্জীবিত করতে। প্রচণ্ড পরিশ্রমে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তথাপি জনগণের পাশে থাকার সংকল্পে ছিলেন অবিচল।
১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’ পরিকল্পনা করেন এবং ১৯৭৩ সালে এ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। আজকের বাংলাদেশে এই কর্মসূচির মাধ্যমে লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবক সেবা দিয়ে যাচ্ছে দুর্গত এলাকার জনগণকে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তিনি মানুষ ও তাঁর সম্পদ রক্ষায় উঁচু ঢিবি নির্মাণ করতে বলেন। স্থানীয় জনগণ ভালোবেসে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সে আশ্রয়স্থলের নাম দেন ‘মুজিব কিল্লা’। পরবর্তীকালে সব ‘মুজিব কিল্লা’ বেদখল হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ দেন। বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণ প্রকল্পসহ উপকূলীয় জনগণের জন্য পরিকল্পিত আশ্রয়স্থল নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বন্যাদুর্গত এলাকায় তৈরি হচ্ছে আশ্রয়স্থল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য নিজস্ব তহবিল ঘোষণা করেন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ কৌশল নামে একটি কার্যক্রম হাতে নেন। একুশ শতকের বাংলাদেশ দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের জনগণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; সে রকম নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।
দুর্যোগ নিয়ে প্রায় সব লেখায়ই আমি উল্লেখ করি যে, এই ভূখণ্ডে দুর্যোগের ইতিহাস যত দীর্ঘ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ইতিহাস ততটা নয়। বিশেষ করে পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৫৪-৫৫ সালের বন্যা আর ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর সেই শাসকদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অবহেলা সারাবিশ্বেই আলোচিত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে জাতির পিতাকে নিতে হয়েছে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। একটি ছিল যুদ্ধ নামক দুর্যোগ আর অন্যটি ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অনেকটাই নিজ চোখে বাস্তবায়িত হতে দেখে যেতে পারেননি। পরবর্তী সরকারগুলো অনেক কাজ বন্ধ করে দিয়েছে অসমাপ্তভাবে। ১৯৮৭-৮৮ সালের বন্যায় আর ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় প্রাণহানি ও ক্ষতিগ্রস্ততার খতিয়ান বিশ্বের সামনে তাই প্রমাণ করে। সরকারি পর্যায়ে যে কাঠামোগত পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছিলেন, তা অনুসরণ করা হলে বাংলাদেশের জনগণের দুর্যোগ ঝুঁকি লাঘব হতো।
১৯৯১ সালের ক্ষয়ক্ষতির পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরামর্শে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর পরিচালনার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালীন ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি)’ প্রকাশিত হয়। সেখানে দুর্যোগের আগে ও পরে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত দুর্যোগপূর্ব-দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ-পরবর্তীকালীন কে কী দায়িত্ব পালন করবেন, তা লিপিবদ্ধ থাকে। এ পর্যন্ত এসওডি তিনবার হালনাগাদ করা হয়েছে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী। পূর্ববর্তী দুর্যোগগুলো এবং ২০০৭ সালের বন্যার পর বিভিন্ন দাতা দেশের পরামর্শে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি সমন্বিত কর্মসূচি দুটি পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। তবে প্রথমেই যে বিষয়টি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের বিশ্নেষণে আসে তাহলো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব নীতিমালা তৈরি করা হবে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ বা লোকবল নেই। সে কারণে ২০০৯ সাল থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে (বিশেষত যাদের মাঠ পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রম বা গবেষণার অভিজ্ঞতা আছে) জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আমাকে খুঁজে বের করে একটি প্রকল্পের সমন্বয়ক করা হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর দুর্যোগে সাধারণ মানুষের বিশেষত সংগ্রামী নারীদের টিকে থাকা নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে আসার পর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ‘দুর্যোগের সমাজবিজ্ঞান’ নামে একটি কোর্স পড়ানো ছাড়া ব্যাপকভাবে কাজ করার সেই প্রথম সুযোগ পেলাম। সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) ও সহকর্মীদের সহায়তায় আমরা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিই। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণও নিই। সরকারের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। সব স্থানে বঙ্গবন্ধুর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দূরদর্শিতামূলক দিকনির্দেশনাগুলো জানাতে পারি। আমরা দেখতে পাই, অনেকের কাছেই বিষয়গুলো অজানা। এমনকি ১৯৭৩ সালে সেই ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি সম্পর্কেও অনেকের জানা ছিল না। সময়ের প্রয়োজনে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। যার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ (সিডিভিএস)’ কেন্দ্রটি সমাজবিজ্ঞানের অভ্যন্তরে এই বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা ও প্রফেশনাল মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য ভর্তি হন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পরিবার বড় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তখন সরকারি পরামর্শে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান শুরু করার জন্য আবেদন করা হয়। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ নামে অনুমোদন লাভ করে। ওই বছরেই সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আলাদা হয় এই ইনস্টিটিউট। ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। তাই ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে জাতির পিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা আয়োজন করি চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার। ‘যুদ্ধ একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ’ শিরোনামে এই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও আগত দর্শনার্থীরা অবলোকন করে মহান নেতা ও তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় জাতির পিতার আদর্শে উজ্জীবিত এই প্রতিষ্ঠানটি কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হয়নি বরং প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এ দেশের দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে স্বপ্ন জাতির পিতা দেখিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের জন্য। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে গত চার বছর ধরে আমাদের শিক্ষার্থীরা মাঠ পর্যায় থেকে যেসব তথ্য এনে দিচ্ছেন, সেগুলো দিয়ে মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা সংযোজিত বা সংশোধিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২০১৩ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়টি আমাদের সহায়তা নিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ‘জেন্ডার টুলকিট’ তৈরি করেছি।
একজন সাহসী তরুণ যার পদচারণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হয়েছে, তাঁর জন্মশতবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। এরই অংশ হিসেবে ১০ মার্চ ২০২০ তারিখে সকাল ১০টা থেকে শুরু করে ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ আয়োজন করেছে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, সে নিয়ে আমরা কখনও আত্মতৃপ্তি বোধ করি না। বরং মনে করি, জাতির পিতার স্বপ্ন ও দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে আমাদের দৃষ্টি হতে হবে তাঁর মতো সুদূরপ্রসারী।
অধ্যাপক; পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়