ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হচ্ছে। এ নিয়ে সব ভোটারদের মধ্যেই কাজ করছে কৌতুহল। কেউ ভাবছেন, ইভিএম খুব জটিল আবার কারও কাছে খুব সহজ মনে হচ্ছে এই পদ্ধতি।
ভোট দিয়ে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের দুই সাংবাদিক তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
আবদুর রহিম হারমাছি, প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক:
শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হচ্ছে শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডে জিনিয়াস কেজি স্কুলে। সকাল ১০টার দিকে এই কেন্দ্র গিয়ে দেখি, বাইরে খুব বেশি ভোটার নেই। পরিবেশ বেশ শান্ত। শুধু পুরুষরা ভোট দিচ্ছেন। প্রথমবারের মত ইভিএমে ভোট দেই আমি। মাত্র এক মিনিটেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই ভোট দিয়েছি।
বুথে ঢুকার পর জাতীয় পরিচয়পত্র চাইলেন পোলিং অফিসার। পরিচয়পত্র দেওয়ার পর তিনি একটি মেশিনে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল চেপে ধরতে বলেন। প্রথমবারেই আঙুলের ছাপ মিলে গেল। এরপর এক পোলিং অফিসার ভোটার তালিকায় নামের পাশে টিপ দিতে বলেন। টিপ দেওয়ার পর আরেক পোলিং অফিসার আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দেন।
এরপর গোপনকক্ষে ঢুকে ভোট দিতে বলা হয়। গোপনকক্ষে ঢুকে দেখলাম, ইলেকট্রনিক ব্যালট ইউনিটে মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের জন্য তিনটি ব্যালট ইস্যু করা রয়েছে। প্রতিটি ব্যালট ইউনিটের স্ক্রিনে প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক রয়েছে। প্রত্যেক প্রতীকের পাশে একটি করে সাদা বোতাম।
প্রথমে আমি মেয়রের ব্যালট প্যাডে পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকের ডান পাশে সাদা বোতামে চাপ দেওয়ার পর স্ক্রিনে প্রার্থীর ছবি ভেসে উঠে। এরপর ব্যালট ইউনিটের নিচে ‘কনফার্ম’ লেখা সবুজ বোতামে চাপ দিতে বলা হয়। সেখানে চাপ দিলে ভোট দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে বলা হয়।
ঠিক একইভাবে সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের ভোটও দিয়েছি।
কাজী নাফিয়া রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক:
আমার কেন্দ্র ছিল মিরপুর ১২ নম্বর ডি ব্লকের প্যারাডাইস কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাই স্কুল। এটি নারী ভোটকেন্দ্র। দুই নারী নির্বাচনকর্মী ভোটার নম্বর দেখে আমাকে জানিয়ে দিলেন, আমাকে ২ নম্বর কক্ষে ভোট দিতে হবে।
ভোটকক্ষে প্রবেশের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানতে চাইলেন আমি ভোটার কিনা। নিশ্চিত হয়ে তারা আমাকে ভেতরে যেতে দিলেন।
ভেতরে ঢুকে দেখলাম প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট। ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। প্রিজাইডিং অফিসার আমার ভোটার স্লিপের নম্বরটি দেখে তার তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন।
আঙুলের ছাপ নেওয়ার পর পর কন্ট্রোল ইউনিটে স্ক্রিনে ‘আবার যাচাই করুন’ লেখাটি ভেসে উঠল। এরপর আবার চেষ্টা করতে মিলে গেল। তখন স্ক্রিনে আমার নাম, ছবি, ভোটার আইডি কার্ড নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য চলে এলো। এক পোলিং অফিসার ভোটার তালিকায় আমার নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে রাখলেন।
এরপর সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আমাকে গোপনকক্ষে গিয়ে তিনটি ব্যালট প্যাডে ভোট দিতে বললেন। তিনি ভোট দেওয়ার পদ্ধতিও আমাকে জানিয়ে দিলেন। এরপর আমি কালো কাপড়ে ঢাকা গোপন কক্ষে চলে গেলাম। প্রথম প্যাডে মেয়র, দ্বিতীয়টিতে সাধারণ কাউন্সিলর ও পরেরটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে ভোট দেওয়া যাবে।
প্রথমে পছন্দের মেয়র প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য তার ছবির পাশের সাদা বোতামটি চাপার সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনটি জ্বলে উঠল এবং ‘কনফার্ম’ বোতামটি চেপে ভোটটি প্রয়োগের জন্য বলা হল। এভাবে সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের ভোট দেওয়ার পর মেশিন থেকে ‘আপনার ভোট দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে’ বলা হলো।
এভাবে মাত্র ৩০ সেকেন্ডেই বাটন চেপে ভোট দিয়ে ফেললাম। এরপর একজন পোলিং অফিসার আমার আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দিলেন এবং অন্য একজন পোলিং অফিসার আমার ভোটার তালিকার পাশে স্বাক্ষর করতে বললেন। ভোট দেওয়া শেষ হল।
আইরিন সুলতানা, মডারেটর, ব্লগ.বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
এটা ছিল আমার ইভিএমে প্রথম ও প্রতীক্ষিত ভোট। পল্লবী এম আই মডেল হাই স্কুলকে ঘিরে সকাল থেকেই এলাকা সরগরম। রাস্তার মোড় থেকে ভোটার স্লিপ নিলাম। হেঁটে যেতে যেতে র্যাবের দুটো গাড়ি পাশ কাটালাম।
ভোটার স্লিপ হাতে স্কুলের বিশাল মাঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম পথের মত এখানেও মানুষের সমাবেশ। ছোট ছোট জটলা, পুলিশও প্রচুর। স্কুলের তিনটি আলাদা আলাদা ভবন। এক ভবনে নারীদের ভোট নেওয়া চলছে।
ভবনের নীচ তলায় প্রবেশমুখে স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা রয়েছে, আনসার-পুলিশও রয়েছেন। তবে এদের সাহায্য না নিয়েও ভোটার স্লিপের নম্বর মিলিয়ে বার করে নেওয়া যায়, কয় তলায় আর কত নম্বর কক্ষে যেতে হবে।
দোতলায় ২০৭ নম্বর ছিল সবশেষ কক্ষ। এই স্কুলেই এক সময় পড়েছি বলে পায়ে কোনো দ্বিধা ছিল না। তবু প্রতিটি কক্ষ পার হতে গিয়ে দায়িত্বরতদের কেউ না কেউ নম্বর মিলিয়ে দেখেছেন।
পথে, মাঠে, দোতলার বারান্দায় আর ভোটিং কক্ষের ভেতরে সবুজ জমিনে লাল পাড়ের আনসার নারীদের দেখে আমার মনে হচ্ছিল বিজয়ে দিবসের কোনো আয়োজনে এসেছি বুঝি।
দোতলায় প্রতি কক্ষেই ভেতরে-বাইরে ভিড়। সব কক্ষেই চারটার মত টেবিল। কক্ষে সবাই ভোটার নয় অবশ্য, নির্বাচনে দায়িত্বরতরাই মূলত। ২০৭ নম্বর কক্ষটিতেই শুধু দোতলার বাকি সব কক্ষের চেয়ে কম ভিড় নজরে এলো। ঢুকতেই একটি টেবিলে দুজন শশব্যস্ত। আর বামে একটা টেবিলে ‘কম ব্যস্ত’ দুজন বসে আছেন। বুথের একটু পাশে রাখা টেবিলে একজন ভোটার যাচাই করার ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে বসে আছেন।
ভোটার স্লিপ থেকে নম্বর মিলিয়ে পোলিং অফিসারের হাতে থাকা তালিকায় নাম-ছবি মিলিয়ে যেতে হলো ডিজিটাল যাচাই করতে। সেখানে আমার মায়ের হাতের ছাপ মিলছিল না দুই-তিন বার চেষ্টার পরও। মনে হলো- ওই কক্ষে এই ঘটনা এটাই প্রথম ছিল; পোলিং এজেন্টদের দ্বিধান্বিত দেখলাম।
একজনকে বলতে শুনলাম, তাহলে তো হবে না! আমি বললাম, ভোটার আইডি কার্ডের নম্বর দিয়ে চেষ্টা করে দেখুন না একবার…। ভোটার আইডি কার্ডের নম্বর বসাতেই মনিটরে ভেসে উঠলো ভোটারের ছবিসহ পরিচয়; যাচাই সফল। অফিসাররাও বলে উঠলেন, হয়েছে-হয়েছে।
পরিবারের বয়স্কতম সদস্যের ডিজিটাল অভ্যস্ততা শূন্যের আশেপাশে বলা চলে। বুথে ঢোকার আগে অফিসার একবার ‘থাম্ব রুল’ বলে দিলেন তাকে; সাদা বাটনে চাপ দিতে হবে, তারপর সবুজ বাটনে।
সফল ইভিএম ভোট শেষে বেরিয়ে এসে তারপর তাকে ভোটারের নামের তালিকায় টিপসই দিতে বলা হলো। আমি মৃদুস্বরে বললাম, উনি তো হাতে লিখতে পারেন, বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ কেন? বলা হলো, টিপসই দিলেও সমস্যা নেই।
আমার বেলায় ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ ডিজিটাল যন্ত্র একবারেই চিনে গেল। মনিটরে সেকেন্ডের মধ্যে ভেসে উঠলো ছবি-নাম। তারপর বুথে গিয়ে তিনটি ডিজিটাল ব্যালটের সাথে দেখা। প্রথম ব্যালটে বোতাম চাপাচাপির প্রক্রিয়া শেষ করেছি; যন্ত্রের স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠেছে ‘মার্কা’সহ সফলতার বার্তা।
স্ক্রিনে কি এটা থেকেই যাবে, না পরের ব্যালটে ঝাঁপ দেব তা জানতে চাইলাম একটু গলা তুলে। তবে আমাকে নির্দেশনা দিতে গিয়ে আমার প্রথম ব্যালটের ভোট যেন আবার তাদের চোখে না পড়ে যায়, সেজন্য স্ক্রিনে হাত দিয়ে ঢেকে রাখলাম।
আসলে তিনটি ভোট সফলভাবে দেওয়া শেষ না হলে ‘স্ক্রিন ক্লিয়ার’ হবে না। আর ভোটের পুরো প্রক্রিয়া সফল হলে বাইরে ‘ডিজিটাল প্রিজাইডিং অফিসারও’ সেটা বুঝে যান।
আগে ভোটে আঙ্গুলে অমোচনীয় কালি দিতে হয়েছিল কাগজের ব্যালট হাতে নেওয়ার সময়। এবার দিতে হলো ভোট দেওয়া শেষে। হাতে স্বাক্ষর দিতে তো পারি, তবে আমিও টিপসই দিয়ে ডিজিটাল ভোট সম্পন্ন করলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একটু দাঁড়াতেই হলো। বেশ বয়স্ক শীর্ণ শরীরের এক নারীকে কোলে নিয়ে উঠছেন একজন। ভোট কি তাহলে নাগরিকদের আগ্রহকে গভীরে ছুঁতে পারছে?
কে কাকে তার গোপন ভোটটা দিল, সেটা নিয়ে সবারই আগ্রহ থাকে। তবে আমার খোলাখুলি বলতে সংকোচ নেই, এবার ভোটটা ইভিএমেই দিয়েছি।