নিজস্ব প্রতিবেদক,রাণীনগর: নওগাঁর রাণীনগরের বেশ কয়েকজন যুবক দীর্ঘ দিন ধরে প্রবাসে ছিলেন। সেই প্রবাসে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে দেশে এসে কেউ কারখানা খুলেছেন,আবার কেউ খেজুর গাছের বাগান করেছেন। কেউবা আবার চায়না দড়ি তৈরির কারখানা দিয়ে বসেছেন।তারা বলছেন,বিদেশে কারখানায় যে কাজ করতেন দেশে এসে সেই কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছেছেন।
এছাড়া এসব কারখানায় এলাকার বেকার যুবকদের সৃষ্টি হয়েছে নানামূখি কর্মসংস্থান। তাদের মতে, দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমীক বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানান কাজে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জণ করেছেন।বিদেশ থেকে এসে বসে না থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভাল কিছু করা সম্ভব। তবে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ ফেরতরা প্রয়োজনমত অর্থ না থাকায় তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেননা।
ফলে সরকারীভাবে সহযোগিতা করলে একদিকে যেমন নানান ধরনের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব দুর হবে,অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। বিলকৃষ্ণপুর ধোপাপাড়া গ্রামের ছলিম উদ্দীনের ছেলে আব্দুল মজিদ (৫০) বলেন,গত ২০০০সালে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। একটানা দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০২০ সালে দেশে এসেছেন। তিনি বলেন,সৌদি আরবে একটি অফিসে ক্লিনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তার কর্মস্থল অফিসের আওতায় একটি খেজুরের বাগান ছিল। একটু সময় পেলেই তিনি বাগানে শ্রমীকদের সাথে গাছের পরিচর্যাসহ বিভিন্ন কাজকর্ম করতেন। দেশে গিয়ে কোন কর্ম করে খাবেন তা নিয়ে ভাবনায় পরেন। একপর্যায়ে স্থির করেন দেশের মাটিতে খেজুরের বাগান করবেন। সেই আলোকে খেজুরের বাগান করার অভিজ্ঞতা অর্জণ করেন। তবে কতটুকু সফল হবেন তা নিয়েও ভাবনায় পরেন।
পরে ইউটিউবে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা খেজুরের বাগান দেখে মনে শক্তি সঞ্চার করেন। দেশে আসার সময় সৌদি থেকে ১১০ পিস আজওয়া ও মরিয়ম খেজুরের বীজ নিয়ে আসেন।কিন্তু বাগান করতে চাইলে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার ও গ্রামের লোকজন বাধা প্রদান করে তিরস্কার করতে থাকে। এসব উপেক্ষা করেই পলিথিনে বীজ চারা দিয়ে গাছ গজানোর পর বাড়ীর পার্শ্বে ৩০শতক জায়গায় ৭৯টি গাছ রোপন করেন। ধীর ধীরে গাছ বড় হলেও খেজুর ধরা নিয়ে নানা সংশয় দেখা দেয়।
কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত মৌসুমে গাছে খেজুর ধরতে শুরু করায় সংশয় কেটে যায়। এখন পরিবারএবং গ্রামের লোকজন তার বাগান দেখতে প্রতিনিয়ত ভির করছেন। তিনি বলছেন, বিদেশে প্রতি মাসে আয় করেছেন ৭০-৮০ হাজার টাকা। কিন্তু বাগানে খেজুর গাছের বয়স সাত বছর পরিপূর্ণ হলে ওই ৩০শতকের বাগান থেকেই খেজুর এবং গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা বিক্রি করে বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আয় হবে বলে আসা করছেন তিনি।বাগান করতে লক্ষাধীক টাকা খরচ হলেও ইতি মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার টাকার গাছের চারা বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন আব্দুল মজিদ। উপজেলার ভেটি গ্রামের বেলাল উদ্দীনের ছেলে গোলাম রাব্বানী (৪২) বলেন,তিনি সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ধার-দেনা করে গত ২০০৪ সালে মালোয়েশিয়াতে গিয়েছিলেন।
সেখানে প্রথমে একটি কোম্পানীতে কাজ করলেও পরে প্রায় ১৩ বছর ধরে একটি কাঠের ফার্নিচারে শ্রমীক হিসেবে কাজ করেছেন। সেখানেই ডিজিটাল মেশিনে বিভিন্ন কাঠের আসবাবপত্রে নকশিকাটার কাজ শেখেন। তিনি বলেন, বিদেশী ফার্নিচারে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করে বাড়ীতে আসার আগেই ঠিক করেন দেশে গিয়ে অনুরুপ একটি কারখানা খুলবেন। গত দেড় বছর আগে বাড়ীতে এসে আবাদপুকুর বাজারে ছয়টি রুম ভাড়া নিয়ে প্রায় ১০/১২ লক্ষ টাকায় কাঠের বিভিন্ন আসবাবপত্রে নকশি কাটার ডিজিটাল মেশিন ক্রয় করে “মেসার্স শারমিন ফার্ণিচার এন্ড ডোর“ নামে কারখানা খুলেন।
তিনি জানান,বর্তমানে একজন ডিজাইনারসহ ৭জন কর্মচারী কারখানায় কাজ করছেন। রাব্বানী জানান, জায়গা পরিধি কম হওয়ায় কারখানা এখনো পুরো-পুরি চালু করতে পারিনি। তার পরেও খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে ৩০/৪০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। কারখানা পুরোদমে চালু হলে বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুন বেশি আয় হবে বলে আসা করছেন তিনি। তিনি আরো বলেন,বিদেশে যে পরিমানে কামাই-রোজগার করেছেন,দেশে কারখানা খুলে তার বেশি রোজগার হবে। তাই আর বিদেশ যেতে চাননা তিনি।
রাব্বানীর মতে, দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমীক বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানান কাজে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জণ করেছেন। ওইসব শ্রমীকরা চাইলে বিদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের মাটিতেই ভাল কিছু করতে পারবেন। কিন্তু আমার মতো অনেকের ইচ্ছে থাকলেও অর্থ অভাবে তা হয়ে ওঠেনা। তাই বিদেশ থেকে আসা শ্রমীকদের যদি সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয় তাহলে একদিকে যেমন বেকারত্ব ঘুচবে,অন্যদিকে হাজার হাজার পরিবারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরো এগিয়ে যাবে।রাণীনগর উপজেলার উজাল পুর গ্রামের সাহেব আলীর স্ত্রী তহমিনা বিবি বলেন, তার স্বামী মালোয়েশিয়াতে গিয়ে দড়ি তৈরির একটি কারখানায় দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কাজ করেছেন। সেই কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে দেশে এসে আবাদপুকুর বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মেশিনপত্র কিনে চায়না দড়ি তৈরির একটি কারখানা খুলেছেন।
কারখানায় প্রায় ২০/২৫জন শ্রমীক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু অর্থনৈকি সংকট এবং নানা প্রতিকুলতার কারনে গত ৬মাস আগে কারখানা বন্ধ করে আবারোমালোয়েশিয়াতে চলে গেছেন। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কেটে গেলে দেশে এসে আবারো কারখানা চালু করবেন।রাণীনগর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, ২০১৫ সালের পর ২০২৩ সালের মধ্যে বিদেশ থেকে এসে যাহারা খারাপ অবস্থায় আছেন প্রবাসী কল্যান মন্ত্রনালয় থেকে একটি প্রোজেক্টের আওতায় তাদের বায়োডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে।
হয়তো সরকার কেবলমাত্র তাদেরকে সহায়তা করতে পারেন। এছাড়া যুব উন্নয়ন ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বেকার যুবকদের ঋণ সহায়তা করা হয়ে থাকে। বিদেশ ফেরতরাও অবসর বসে না থেকে যুব ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সহায়তা নিয়ে নানামূখি কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন।