যাদের জন্য ভিপি হয়েছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা নেওয়াই হয়েছে নূরের মুখ্য কাজ। আর এই পথে তিনি বেছে নিয়েছেন ধর্মাশ্রয়ী ও সস্তা ভারত বিরোধিতার রাজনীতি।
বিনোদন জগতে অনেকেই হঠাৎ তারকা বনে যান। নির্দিষ্ট কোনো গান গেয়ে বা নাটক-সিনেমার নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসার ঘটনা নতুন কিছু না। শুধু বিনোদন কেন, অন্য অনেক ক্ষেত্রেও এমন ‘হঠাৎ তারকা’ দেখা যায়। এসব ‘হঠাৎ তারকা’ আবার হঠাৎ করেই হারিয়ে যান। কারণ তাদের ভিত্তি দুর্বল থাকে, অভিজ্ঞতা কম থাকে, সামগ্রিক মানের ঘাটতি থাকে, এবং সর্বোপরি কাজটার প্রতি অঙ্গীকার থাকে না। তাদের লক্ষ্য থাকে যেনতেনভাবে রাতারাতি বড় হওয়া। রাজনীতিতেও মাঝে মাঝে ‘হঠাৎ তারকা’র দেখা মেলে। দ্রুত উত্থানের মতো তাদের পতনও দ্রুত হয়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনই এক ‘হঠাৎ তারকা’কে দেখা যাচ্ছে।
২৮ বছর পর ২০১৯ সালে যখন ডাকসুর নির্বাচন দেওয়া হয় তখন সবাই আশা করেন, ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে আবারও ভূমিকা রাখতে শুরু করবে। সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ তুলে ধরবে দেশের শীর্ষ এই বিদ্যাপীঠ। ছাত্র রাজনীতির গৌরব ফিরিয়ে আনতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে ডাকসু এবং আবাসিক হল সংসদগুলো। কিন্তু সেই প্রত্যাশা প্রথমেই হোচট খায় নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগের কারণে। অতীতে যারা ডাকসুর ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছেন। প্রতিটি ডাকসুই ক্যাম্পাসের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯০ সালে নির্বাচিত ডাকসু এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটায়। স্বাধীনতার আগে ও পরে জাতীর প্রতিটি সংকটেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে শত বছরের পুরানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেজন্যই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার’ হিসাবে পরিচিত।
টানা ২৮ বছর ডাকসু ও হল সংসদ না থাকায় সেই ইতিহাসে বড় ধরনের ছেদ পড়ে। এই ২৮ বছরে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাদের কাছে সেই ইতিহাস শুধুই ইতিহাস। কিন্তু ২০১৯ সালে যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, তাদের জন্য ডাকসু ও হল সংসদের জীবন্ত রূপ দেখার একটা সুযোগ আসে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির সুফল ভোগ করার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। একই সাথে জাতীয় নানা সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখার সুযোগও তৈরি হয় দীর্ঘ ২৮ বছর পরে। ২০১৯ সালে বহু কাঙ্ক্ষিত ডাকসু নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তি করা ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মতো সংগঠনগুলোকে পিছনে ফেলে ভিপি নির্বাচিত হন, সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হক নূর। কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন এই সংগঠনটির জন্ম। এত বছর পর ডাকসু নির্বাচনে বিপ্লব করে ফেলবে সেটা নিশ্চয়ই কেউ আশা করেনি। কিন্তু পুনরুজ্জীবিত ডাকসু তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকার শুরুটা অন্তত করবে, এমন আশা নিশ্চয় অনেকেই করেছেন। কিন্তু জিএস ও এজিএসসহ ডাকসুর বেশিরভাগ পদে নির্বাচিত ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে ভিপির প্রকাশ্য এবং সহিংস দ্বন্দ্ব চলে ডাকসুর এক বছর মেয়াদের পুরোটা জুড়েই। নামে-বেনামে ছাত্রলীগ কর্মীরা ভিপি নূরের ওপর অনেকবার হামলা চালায়। তাতে নূরের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সারাদেশের মানুষেরই সহানুভূতি তৈরি হয়। মূলত তাদের এমন বিরোধের কারণেই ২৮ বছর পর পাওয়া ডাকসু সবচেয়ে ব্যর্থ ডাকসুতে পরিণত হয়। অন্যদিকে, নিজের অরাজনৈতিক সংগঠনের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি ভিপি নূর। ছাত্রলীগের বিরোধিতা ও অসহযোগিতার কথা বলে নিজের ব্যর্থতাকেও আড়াল করার চেষ্টা করেন তিনি।
ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর নূর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে যান, তখন নিজেকে এক সময়ের ছাত্রলীগ কর্মীর পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু দ্রুতই তিনি রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে ফেলেন। এক পর্যায়ে ডাকসুর শীর্ষ নেতার দায়িত্ব পালনের বদলে ছাত্রলীগ-বিরোধী রাজনীতি শুরু করেন তিনি। সাথে যোগ হয় তার সরকার-বিরোধী রাজনীতি। যাদের জন্য এবং যাদের দ্বারা তিনি ভিপি নির্বাচিত হন, তাদের কথা ভুলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভূমিকায় নামে নূরের ছাত্র সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কিছু করতে না পারলেও জাতীয় নানা বিষয়ে নূরের রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। এরপর ডাকসুর মেয়াদ শেষে সাবেক হয়ে যাওয়া ভিপি পুরোদস্তুর জাতীয় রাজনীতির চর্চা শুরু করেন। জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রকাশ্য কোনো অভিভাবক না থাকলেও, বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনীতি নিয়ে পুরোদমে মাঠে নামে নূরের সংগঠন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব বিষয়েই নিজেদের এবং অন্যদের কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নূর। সামাজিক মাধ্যমেও শুরু হয় তার নিয়মিত উপস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার এবং ভারতের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্রনেতা নূরের বিষোদ্গার।
সরকারের দমন-পীড়ন আর অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও ব্যক্তি নূরের ওপর ভর করতে থাকেন। নিজের সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সরকার ও ভারতবিরোধী বক্তব্য রাখতে শুরু করেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন এবং ধর্মকে যারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন, তাদের সাথে নূরের সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই উপমহাদেশে বারবার ব্যর্থ ও প্রত্যাখ্যাত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও সস্তা ভারত-বিরোধিতায় সরব হয়েছেন ভিপি নূর। এই রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা তাকে নানাভাবে মদদ দিচ্ছেন। তাছাড়া আওয়ামী-বিরোধীরা তো আছেনই। ইউটিউবসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে যারা ধর্মের নামে উন্মাদনা ছড়ান, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে যারা কথায় কথায় আক্রমণ করেন, তাদের কাছে নূর খুবই সমাদৃত হচ্ছেন। বাদ যাচ্ছেন না বিএনপি-জামায়াত জোটের অনুসারীরাও। বাংলাদেশের মুসলমানরা ধার্মিক হলেও ধর্মান্ধ নন, নূর হয়তো এ কথা ভুলে গেছেন।
নূরের এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে তারই সংগঠনের এক নারী কর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ সম্পর্কে নূর যে ধরণের নারীবিদ্বেষী ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা জাতীয় নেতা হতে ইচ্ছুক কারো আচরণ হতেই পারে না। সাধারণ কোনো মানুষের ক্ষেত্রেও এমন বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এখানেই শেষ নয়। এ বিষয়ে ৭১ টিভির সাথে তিনি যা করেছেন, সেটা আরো জঘন্য। একটা জাতীয় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে কর্মীদের লেলিয়ে দেওয়া কোনো নেতার কাজ হতে পারে না। তিনি নেতা হতে চান অথচ জবাবদিহি করতে চান না। ৭১ টিভির অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিতে নাও চাইতে পারেন। কিন্তু সেই টিভির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, বিষোদগার, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে না। নূর ও তার অনুসারীদের পাশাপাশি, সরকারবিরোধী নানা শক্তিও একই তৎপরতা চালাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ এবং উচিত-অনুচিতের কোনো বালাই নেই। ৭১ টিভি বর্জনের নূরের আহ্বানের পর একই কাজ করছে বিভিন্ন ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদী শক্তিও। ডিবিসি নিউজ ও সময় টিভির বিরুদ্ধেও বিষোদগার করছে তারা। কোনো সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি সবার পছন্দ হবে এমন কোনো কথা নেই। তাই বলে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আন্দোলন কোনো সুস্থ রাজনীতি হতে পারে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্র বা রাজনীতি যেটুকু টিকে আছে, সেটা গণমাধ্যমের কল্যাণেই। সংসদ ও বিরোধী রাজনীতি যেখানে ব্যর্থ, সেখানে গণমাধ্যমই এখনো সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে রেখেছে। সরকার ও সমাজের অন্যায়-অবিচার তুলে ধরছে গণমাধ্যমই। গণমাধ্যমের খবর নিয়েই রাজনীতি করছেন নূরের মতো সরকার-বিরোধীরা। এমন বাস্তবতায় গণমাধ্যমবিরোধী রাজনীতি করে ভিপি নূর কার স্বার্থ রক্ষা করছেন? নানান সমালোচনা, দুর্বলতা আর সীমাবদ্ধতার পরও গণমাধ্যমই এখনো মানুষের শেষ ভরসা। সেই ভরসাটা ধংস করে নূর কার উপকার করতে চাইছেন? উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি সক্রিয় হলে নূরের রাজনীতি কোথায় যাবে?
সরকারের বিরাগভাজন হলে যখন বিএনপির মতো বড় দলের নেতা-কর্মীরাও রেহাই পান না, তখন নূর কীভাবে বহাল তবিয়তে থাকেন? নূরের চেয়ে অনেক কম মাত্রায় সরকার ও ভারত-বিরোধিতা করেও অনেকে গায়েব হয়ে যান, নয়তো কারাগারে যান। মামলার বোঝা তো থাকেই। ধর্ষণে সহযোগিতা এবং সামাজিক মাধ্যমে মানহানির মতো মামলা নিয়েও বীরদর্পে রাজনীতি করছেন নূর। ৭১ টিভির মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও তিনি নিরাপদেই আছেন। নূর প্রায়ই বলে থাকেন, গোয়েন্দারা তাকে নানাভাবে লোভ ও ভয় দেখান। কিন্তু তিনি তাদের পাত্তা দেন না। প্রশ্ন আসতেই পারে নূরের শক্তির উৎস কী? কারা নূরকে জাতীয় নেতা বানানোর চেষ্টা করছেন? বিএনপির বিপরীতে নতুন রাজনৈতিক শক্তি দাঁড় করানোর প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানি আমরা। সেসব চেষ্টায় দেশি-বিদেশি শক্তির জড়িত থাকার কথাও জানেন সচেতন নাগরিকরা।
এরইমধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছেন তিনি। জাতীয় রাজনীতির এই বন্ধ্যাত্বের সময়ে নূরের মতো তরুণ নেতার রাজনীতিতে আসা নিশ্চয়ই ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নূরের কী অভিজ্ঞতা আছে? কোটা পদ্ধতির বিরোধিতা করার মতো একটি জনপ্রিয় বিষয়ে ক্যাম্পাসে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সেই জনপ্রিয়তা দিয়ে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়া কারো জাতীয় নেতা হওয়ার জন্য যথেষ্ট কিনা। ডাকসুর ভিপি হিসাবে ব্যর্থতা কোনো যোগ্যতা কিনা। তবে এটাও ঠিক, রাজনীতিতে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াও অনেকেই মন্ত্রী-এমপি হয়ে গেছেন। কিন্তু নূরের বাস্তবতাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে বিএনপির মতো দলের অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না, সেখানে নতুন দল গঠন করে সফল হওয়া কতটা সম্ভব? ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো জাদরেল রাজনীদিবিদরা যেখানে তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে পারেননি, সেখানে নূরের মতো রাজনীতির ‘হঠাৎ তারকা’র পক্ষে কি সেটা করা সম্ভব? যদিও রাজনীতিতে নবাগত নতুন নেতৃত্বের সাফল্য অনেক দেশেই আছে। সে রকম বিরল সাফল্য পাওয়ার জন্য দরকার বিরল ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা। নূরের মাঝে সেসব গুণ কতটুকু আছে?
নাজমুল আশরাফ: প্রধান সম্পাদক, টিবিএন২৪