সুকুমার ভৌমিকঃ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ ৷’ আমার জানামতে ১৯৩১ সালে কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদ এর অনুরোধে মাত্র ৩০/৩৫ মিনিটের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম এই অসাধারণ কালজয়ী ইসলামী সঙ্গীতটি লিখে দিয়েছিলেন ৷ রসদ ছিল কয়েক খিলি পান আর ২/৩ কাপ চা৷ কবি নিজেই সুর দিয়েছিলেন৷ চার দিনের মধ্যে আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়৷ মাসদুয়েক পরে ঈদুল ফিতর এর আগে রেকর্ড বাজারে ছাড়ার পর অসম্ভব জনপ্রিয়তায় দ্রুত রেকর্ডগুলো বিক্রি হতে থাকে ৷গানের বাণী, সুর ও স্বর্গীয় আহ্বানে মানুষ মুগ্ধ হয়ে যায়৷ খুব সম্ভব এই গানটিই তাঁর রচিত প্রথম ইসলামী সঙ্গীত৷ এরপর তিনি অসংখ্য এবং অপূর্ব ইসলামী গান ও গজল লিখেছেন৷এছাড়াও হাসি,প্রেম,বিরহ, জাগরণী ও বিদ্রোহের গান সহ কীর্তন , শ্যামা সঙ্গীত মিলিয়ে তিনি প্রায় তিন হাজারেরও বেশী গান লিখে গিয়েছেন যার প্রত্যেকটিই অপূর্ব ও অসাধারণ৷ এ বৎসর মহাদুর্যোগের কারণে এক ব্যতিক্রমধর্মী ঈদ পালিত হ’লেও ঈদ উপলক্ষে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের রচয়িতার জন্মদিনও পড়েছে এই ঈদের দিনেই৷ আজ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন৷ তাঁকে চাক্ষুষ দর্শন করার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এবং এ সম্পর্কে বছর তিনেক আগে তাঁর জন্মদিনে আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম৷ আজ এই দিনে লিখাটির উদ্দেশ্য একটু পরিবর্ধন মাত্র ৷ বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে আমি কবি প্রণামের অবিস্মরণীয় কাহিনীর স্মৃতিচারণ করছি৷
আমার বয়স যখন ৬/৭ বছর (১৯৫২/৫৩ )তখন আমার বড়দা আমাকে একটি সুদৃশ্য রঙীন ছড়ার বই এনে দিয়েছিলেন৷তাতে ‘লিচু চোর’,’,’খুকী ও কাঠবিড়ালী ‘খাঁদু দাদু’ প্রভৃতি কবিতা ছিল ৷ বইতে ভরাট মুখের ঝাঁকড়া চুলওয়ালা কবির ছবি দেখিয়ে বড়দা বলে ছিলেন,’ইনি মস্তবড় কবি৷ এখন অসুস্থ,কথা বলতে পারেন না৷’বইতে কবির নাম লিখা ছিল৷তখন থেকে কবির নাম ও চেহারা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল ৷ ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম তাঁর প্রতি৷১৯৭৪ সালের শেষদিকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিতে ঢাকা গিয়েছি৷ উঠেছি আমার সহপাঠী বন্ধু সতীপতির বাসায়৷ সে মতিঝিলে সাবলেটে থাকতো৷ বাংলাদেশ ব্যাংকে স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসার পদে কর্মরত ছিল৷ বহুদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল ঢাকায় গেলে কবিকে দেখে আসবো৷ সতীপতিও আমার সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিল৷ পরীক্ষা শেষে দুই বন্ধু রওনা হ”লাম ধানমন্ডীতে কবি যে বাড়ীতে থাকেন সেই বাড়ীর উদ্দেশে৷ বাড়ীর সামনে রিক্সা থেকে নেমে গেটের কাছে গিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখলাম৷তাতে কবিকে দেখার জন্য দুটি বিশেষ বার (দিন) নির্দিষ্ট করা আছে৷ অন্য কোন বারে তাঁকে দেখানো সম্ভব নয়৷ঐদিন নির্দিষ্ট বারের অন্তর্ভুক্ত ছিল না৷ ভীষণভাবে আহত ও নিরাশ হ’লাম৷গেট থেকে ভিতরে ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছিল৷সেখানে এক জন লোককে দেখে ঈশারায় তাকে ডাকলাম৷ কাছে এলে বললাম, ‘আমরা নাটোর থেকে এসেছি কবিকে দেখতে৷ আজ দেখা না হ’লে আর আমরা দেখার সুযোগ করতে পারবো না৷ ঊমা কাজীর কাছ থেকে অনুমতি আনলে আমরা কবিকে একটু দেখেই চলে যেতাম ৷’ বিজ্ঞাপ্তির নীচে ঊমা কাজীর নাম ছিল ৷লোকটি একটু থেমে বললো,’আপনারা বিকেল পাঁচটায় আসুন৷ খুব খুশী হয়ে সতীপতির বাসায় ফিরে এলাম৷ চারটের আগেই প্রস্তুতি নিলাম৷ কিন্ত কবির জন্য কি নিয়ে যাবো ? শুনেছিলাম কবি মিষ্টি খেতে পছন্দ করেন৷ আমাদের দুর্ভাগ্য,কি একটা কারণে সে সময় দুধ-ক্ষীর-ছানার মিষ্টি তৈরী বন্ধ ছিল৷ কবিকে মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে না৷ অগত্যা ফুলের তোড়া আর ফুলের মালা নিলাম৷ গুরুদাসপুর কলেজের গ্রন্থাগারিক সহ আমরা এখন তিনজন হয়েছি৷ আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত মনস্কামনা পূরণ হতে যাচ্ছে৷ বুকের মধ্যে একটা পুলক মেশানো উৎকন্ঠা অনুভব করছি৷অবশেষে সেই গেটের কাছে পৌঁছলাম৷ বাইরে থেকেই দেখলাম ফুলের বাগানের মধ্যে একটা চেয়ারে কবি বসে আছেন৷পরনে টিয়া রঙের পাঞ্জাবী ও হালকা চেকের লুঙ্গি৷ চোখের সামনে দুই হাতে ধরা একটি পুরানো খবরের কাগজ৷ আগের সেই লোকটি কবির গা-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷গেট পেরিয়েই জুতো খুলে রাখলাম৷ আমাকে দেখে আমার দুই সঙ্গীও জুতো খুলে রাখলো৷ আমার হাতে ছিল মালা ,সঙ্গীদের হাতে তোড়া৷ আমি ছিলাম সামনে৷মালা হাতে ধীর পদক্ষেপে কবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ লোকটি কবির হাত থেকে খবরের কাগজটি সরিয়ে নিল৷ মুখ থেকে অবিরত ব্বুঃ ব্বুঃ করে একটা শব্দ হচ্ছে আর ঠোঁটদুটো সর্বক্ষণ কাঁপছে৷ কবি মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন ৷ ওহ্ সে কি দৃষ্টি ! মনে হলো বড় বড় চোখের প্রসারিত অন্তর্ভেদী স্থির দৃষ্টিতে কবি আমার ভিতরের সর্বস্ব দেখে নিলেন ৷ আনন্দে– উত্তেজনায় – ব্যথায় অভিভূত ও বিমূঢ় হয়ে গেলাম! সচকিত হয়ে মালাটা গলায় পরিয়ে দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম ৷আবার সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ! আমার মেজদা একবার নির্দিষ্ট দিনেই কবিকে দেখতে গিয়েছিলেন৷ তাঁর কাছে শুনেছিলাম কবির ঘরে ঢোকার পরে কবি নাকি বার বার তাঁর ঘরে থাকা সঙ্গীতের যন্ত্রপাতির দিকে ঈশারা করছিলেন ৷ কবি মেজদাকে গান শোনাতে বলছেন বুঝতে পেরে মেজদা হাতজোড় করে ঈশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি গান গাইতে জানেন না৷ তাঁর কাছেই শুনেছিলাম যাঁরা কবির গান বা কবিতা আবৃত্তি করতে জানেন তাঁরা তা করলে কবি খুশী হন ৷ এটা জানার পর আমার সুপ্ত আশা ছিল কবিকে দেখতে গেলে তাঁকে আমি আবৃত্তি শোনাব ৷ দুঃখের বিষয় সেদিন নির্দিষ্ট দিন না থাকায় তা সম্ভব হলো না ৷ এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবার বেদনা আমি কখনো ভুলতে পারি নি৷ সবার প্রণাম হয়ে গেলে কবির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷
ভাবলাম– এই সেই ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা’- চিরতারুণ্যের প্রতীক বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম৷ আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম৷ চোখদুটো জলে ভরে গেল৷ আসার মুহূর্তে তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁরই লিখা একটি গানের প্রথম কলিটি মনে মনে আওড়ালাম —– ‘ ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি৷’
আরও দেখুন
সিংড়ায় যৌথবাহিনীর ব্যাপক তল্লাশি
নিজস্ব প্রতিবেদক,,,,,,, সিংড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালায় যৌথবাহিনী। এসময় তাদের মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, কাভার্ড …