টেলিভিশনকে অনেকে বোকা বাক্স নামে ডাকেন। টিভির আকার ও প্রযুক্তি পরিবর্তন হচ্ছে, নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজনের চেষ্টা চলছে, কিন্তু টেলিভিশনের বোকা ভাব দূর হয়েছে কি না সেই বিষয়ে এখনো সন্দেহ রয়েছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এক বা একাধিক টেলিভিশন রয়েছে। টিভি যত দামেরই হয়ে থাক, চ্যানেল পরিবর্তন করা ছাড়া এই যন্ত্রের তেমন আর কোনো ব্যবহার করার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মাশরুর হান্নান টেলিভিশনকে বিনোদনের মাধ্যমের পাশাপাশি কম্পিউটার হিসেবে বিকল্প ব্যবহারের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। অনন্য এই উদ্ভাবন প্রথম ধাপে উন্মুক্ত করা হবে মাসখানেকের মধ্যো। আর সবার জন্য ব্যবহােরর উপযোগী নানা মডেল বাজারজাত করা হবে আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে।
সিআরটি, এলসিডি বা এলইডি যেমন টিভিই হোক, জাদুর ছোঁয়ায় যেন সেটি একটি পূর্ণ ডেস্কটপ কম্পিউটার হয়ে যাবে। এ চিন্তা থেকেই মাশরুর জাদুপিসির নকশা প্রণয়ন করেছেন। কম্পিউটারে নিয়মিত কাজের জন্য দরকারি সব অ্যাপ্লিশকেশনও ইনস্টল করা যাবে, আর টিভি তো টিভির মতো থাকছেই।
আরও বিশেষ ব্যাপার হলো, এখানে স্মার্টফোনের যাবতীয় সুবিধাগুলো উপভোগ করা যাবে। ফলে দৈনন্দিন কাজের অফিস অ্যাপ্লিকেশন যেমন ব্যবহার করা যাবে, শিক্ষা বা বিনোদনের অন্যান্য অ্যাপও তেমন পাওয়া যাবে এখানে। অনেকে হয়তো এটিকে স্মার্টটিভি বা অ্যান্ড্রয়েড বক্সের মতো কিছু ভাবতে পারেন। কিন্তু কাজের দিক থেকে বাজারে প্রচলিত এমন ধরনের সব যন্ত্র থেকে একেবারেই অনন্য এটি।
যে যন্ত্রটির কথা বলা হচ্ছে সেটির নাম ‘জাদুপিসি’। যেকোনো ধরনের টিভি, মনিটর, প্রজেক্টর বা পর্দার সঙ্গে এটি যুক্ত করে সেটি কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সঙ্গে সুবিধা অনুযায়ী তারহীন কি–বোর্ড ও মাউস যুক্ত করে নেওয়ার সুযোগ আছে। কম মূল্যে কম্পিউটার তৈরির এই প্রকল্পের একেবারে শেষভাগের কাজ চলছে ঢাকার বনানীতে। বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারকারীর ধরন বুঝে জাদুপিসির আলাদা সংস্করণ থাকবে এবং বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ব্যবহারের সুবিধা থাকবে। ন্যূনতম বৈশিষ্ট্যে জাদুপিসির দাম শুরু হবে ৫ হাজার টাকা থেকে।
জাদুপিসি কী? তুলনামূলক অনগ্রসর, স্বল্প আয়ের এবং আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোতে প্রথমে এই জাদুপিসির কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে চান, জানালেন এর বিক্রয় ও সরবরাহ পরামর্শক সাকিব নূর বিল্লাহ। তবে জাদুপিসি কোনো একটি শ্রেণির জন্য তৈরি করা হচ্ছে না। বরং কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য সংযোজন করে নতুন নতুন সংস্করণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
জাদুপিসি তৈরি, মান উন্নয়নের কাজগুলোর জন্য নিয়োজিত আছে দেশের প্রযুক্তিবিদের একটি দল। পাশাপাশি বিদেশি পরামর্শকও আছেন, যাঁরা জাদুপিসির নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিয়মিত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।
কিসে চলবে কী থাকবে? জাদুপিসির অপারেটিং সিস্টেম এবং এখানে কী ধরনের অ্যাপলিকেশন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেদের বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার পরে বেছে নেওয়া হয়েছে অ্যান্ড্রয়েডকে। জাদুপিসির ডেভেলপার টিম লিডার নাফিস খাবির বলেন, জাদুপিসি যেহেতু আমাদের নকশায় তৈরি হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হবে, তাই অপারেটিং সিস্টেমের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করার ফলে লিনাক্স কার্নেলের নানা ধরনের সুবিধা আমরা কাজে লাগাতে পারছি এবং একই সঙ্গে রয়েছে অ্যান্ড্রয়েডের বিশাল অ্যাপ ভান্ডার।
এই কথার সঙ্গে জাদুপিসির প্রতিষ্ঠাতা ও কারিগরি প্রধান মাশরুর হান্নান যোগ করেন, ‘আমাদের প্রথম লক্ষ্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। সব কন্টেন্ট বা অ্যাপ্লিকেশন আমরাই তৈরি করব এমন না। বর্তমানে জনপ্রিয় সব অ্যাপ এখানে ব্যবহার করা যাবে এবং এর উপযোগী নতুন নতুন অ্যাপ তৈরির সুযোগ থাকছে।
যদিও সব ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করার সুযোগ থাকছে, কিন্তু এই সবকিছুই কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আলাদা ব্যবহারকারীর আলাদা অ্যাকাউন্ট থাকলেও মূল অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যান্য অ্যাকাউন্টের কাজের ধরন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে।’ তিনি আরও জানালেন, জাদুপিসির দল তৈরি করতে ওয়াকিল আহমেদের বড় অবদান রয়েছে। তিনি িছলেন রিবুট কনসালট্যান্ট।
বাজার লক্ষ্য: দেশের যেকোনো স্থানে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করা জাদুপিসির একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। যন্ত্রের নকশা করা, অপারেটিং সিস্টেম তৈরি এবং অন্য সব অ্যাপের ক্ষেত্রে এই ধারণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখানে সব কিছু বাংলায় ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। আর যেকোনো স্থান বলতে এমন সব স্থান হতে পারে যেখানে বিদ্যুৎ সহজলভ্য নয়। জাদুপিসি ৫ ওয়াট বিদ্যুৎ খরচে চলতে পারে, ফলে ব্যাটারি, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমেই এটি ব্যবহার করা সম্ভব।
বাড়িতে টিভির বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে এই জাদুপিসির মাধ্যমে। প্রচলিত বিনোদনের কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি শিক্ষামূলক নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যাবে। ইন্টারনেটের বিশাল জগৎটা কাছে চলে আসবে আর ব্যবহার করা যাবে সব একসঙ্গেই।
নিয়মিত যোগাযোগের জন্য যেখানে মোবাইল ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে ইন্টারনেটযুক্ত জাদুপিসি হয়ে উঠতে পারে অনলাইনে যোগাযোগের মূল মাধ্যম। এটি যেমন ওয়াই–ফাইয়ে যুক্ত হতে পারে, তেমনি মোবাইল সিমকার্ড যুক্ত করা হলে দেশের যেকোনো স্থান থেকেই ইন্টারনেটে যুক্ত থেকে এটি ব্যবহার করা যাবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: ডিজিটাল প্রযুক্তির সেবাগুলো মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসার জন্যই এই উদ্ভাবনের চেষ্টা। বাংলাদেশ সরকার যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে জাদুপিসি মানুষের নিত্যদিনের নিয়মিত অনুষঙ্গ। গত বছরের শেষ দিক থেকে জাদুপিসি দলটি নতুন এই উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই বছরের মধ্যেই তারা প্রথম সংস্করণটি সবার জন্য উন্মুক্ত করবে। তবে এই গবেষণার কাজটি ব্যয়সাপেক্ষ। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব অর্থায়নে চলছে। তবে সারা দেশে এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশি এই উদ্ভাবনটি ছড়িয়ে দেওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে সেটার অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যদি সঠিক বিনিয়োগ না পাওয়া যায়।
জাদুপিসি যে ধারণা নিয়ে কাজ করছে তা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির ৯টির সমাধান দিতে পারবে বলে উদ্যোক্তারা মনে করছেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মানসম্পন্ন শিক্ষা, বৈষম্য কমানো, লিঙ্গ সমতা, সরাসরি কাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন যেমন নতুন নতুন কাজ ও উদ্ভাবনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছিল, দেশের প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি জাদুপিসি তেমনই একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারে।