- উন্নত দেশে প্রশিক্ষিতদের চাহিদা বাড়ছে
- দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে ৭০ সেন্টারে প্রশিক্ষণ
- রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়াতে
- বাজেটে আরও প্রণোদনা আসছে
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় জনশক্তি রফতানিতে সুবাতাস বইছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রেকর্ড পরিমাণ জনশক্তি রফতানি হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ শ্রমশক্তি রফতানির সুযোগ বাড়ায় এই বছর রেমিটেন্স আয়ের প্রত্যাশা আরও বেড়েছে। আগামী বাজেটেও রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়াতে প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া শর্তের বেড়াজাল কাটিয়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু হলে শ্রম রফতানিতে নতুন মাত্রা পাবে। ইতোমধ্যে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। পুরুষের সঙ্গে নারী শ্রমিকের বিদেশযাত্রাও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। রেমিটেন্সে গতি আনতে সরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির ওপর জোর দিচ্ছে। সবমিলে দেশে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স হাতছানি দিচ্ছে।
বিএমইটির তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের চার মাসে মূলত বিশ্বের ২০টি দেশে শ্রমিক কাজে গেছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৪ জন, যা মোট জনশক্তি রফতানির ৬১ শতাংশ। এছাড়া ওমানে ৫৬ হাজার ৮৩০, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫১ হাজার ৫৩১ জন, সিঙ্গাপুরে ১৮ হাজার ৬০৬, জর্দানে ৬ হাজার ৬৫৪ এবং কাতারে ৬ হাজার ২৪১ জন গেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে গত ২০২১ সালে মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিল। গত ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ শ্রমিক বিদেশে গিয়েছিল।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে রেমিটেন্সে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। ২০২১ সাল পর্যন্ত ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হয়। ওই সময় পর্যন্ত প্রবাসীরা ১০০ টাকা দেশে পাঠালে ২ টাকা প্রণোদনা পেতেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রণোদনা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়। প্রবাসীরা এখন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে আড়াই টাকা প্রণোদনা পাচ্ছেন।
অন্যদিকে শ্রমবাজারে আশা জাগিয়েও মালয়েশিয়াতে শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়নি। শ্রমিক পাঠাতে কয়েকটি কোম্পানিকে নির্ধারণ করে দেয়াসহ বেশ কয়েকটি নতুন শর্তারোপ করায় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়াটি ঝুলে আছে। বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েকবার বৈঠক হলেও কোন সুরাহা হয়নি। সময়মতো শ্রমিক না পেয়ে মালয়েশিয়াও শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভারতসহ বিভিন্ন বিকল্প দেশ থেকে শ্রমিক আমদানির চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকার এখনও সেখানে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে আশাবাদী।
বিএমইটির মহাপরিচালক শহিদুল আলম বলেন, সরকার আশা করছে চলতি বছরে রেকর্ড পরিমাণ শ্রমিক বিদেশ গমনের সুযোগ পাবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় পৃথিবীর সব দেশেই জনশক্তির চাহিদা বেড়েছে। সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তিনি আরও বলেন, চলতি বছরে যে পরিমাণ শ্রমিক বিদেশ পাঠানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণ পাঠানো সম্ভব হয়েছে। এখনও বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের চাহিদাপত্র আসছে। এটি সারাবছরই অব্যাহত থাকতে পারে।
বিএমইটির মহাপরিচালক বলেন, শ্রমিকদের দক্ষ বানাতে ইতোমধ্যে দেশের ৭০টি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ চলছে। শুধু রাজধানীতেই ৩টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া প্রতিটি জেলায় একটি করে কেন্দ্র রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকার চলতি বছরে রেকর্ড পরিমাণ শ্রমিক পাঠাতে চায়। তবে শুধু বিএমইটি কাজ করলেই চলবে না, পাসপোর্ট অধিদফতর এবং ব্যাংকগুলোকেও শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাতে যথাসময়ে টাকার জোগান দিতে হবে।
এদিকে ২০২২ সালের প্রথম চার মাসেই নারী জনশক্তি রফতানি আগের মাসের তুলনায় বেড়েছে। সব মিলিয়ে গত চার মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ৪৩ হাজার ৬১০ নারী। মহামারী করোনার প্রভাব কেটে যাওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি নারীদের চাহিদাও বেড়েছে। ডাটাবেজ তৈরি হওয়ায় শ্রমিক রফতানিতে হয়রানি ও প্রতারণার প্রবণতা কমে আসছে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ৪৩ হাজার ৬১০ নারী। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে গেছেন ১০ হাজার ২৯০ জন, ফেব্রুয়ারিতে গেছেন ১০ হাজার ৬১২ জন। মার্চে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ১১ হাজার ২১১ জন। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে এই সংখ্যা আরেকটু বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৪১৭ জন।
একসময় বাহরাইন, লেবানন, জর্দান, হংকংয়ের মতো দেশে প্রচুর নারীকর্মী পাঠানো হতো। তবে সেসব দেশে জনশক্তি রফতানি এক রকম বন্ধই হয়ে গেছে। গত চার মাসের হিসাবে দেখা গেছে, বাহরাইনে একজন নারী কর্মীও পাঠানো যায়নি। লেবাননে ৮৮ জন গেলেও লিবিয়া, ইরাক, ব্রুনেই, হংকং, সুদান ও সাইপ্রাসে একজন নারী কর্মীও যাননি।
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো টাকা। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রাই রেমিটেন্সে বড় প্রভাব ফেলছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিটেন্স এসেছে ২২ বিলিয়ন ডলার। করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে আমদানি খরচ বেড়েছে। এই কারণে রফতানি আয়েও প্রভাব ফেলছে। যার কারণে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর প্রবণতাটি খুবই ইতিবাচক। প্রবাসীদের গত এপ্রিল মাসে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরে একই মাসের সময়ের তুলনায় ১৪৯ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন বেশি। মার্চে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন। ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারি মাসে ১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার, যা আগে একই মাসের তুলনায় ৭৩ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন ডলার বেশি। ডিসেম্বর মাসে রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত চার মাসেই আগের তুলনায় রেমিটেন্স প্রবাহ বেড়েছে।
২০১৯ সালে অতিমারী করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। অতিমারীর আগের বছর ২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯ কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে তা ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনে নেমে আসে। তবে ২০২১ সালে ধীরে ধীরে তা আবার আলোর মুখ দেখতে শুরু করে; যা বছরজুড়েই গতিতে ছিল। মহামারীর আগের সময়ের গতিতে ফিরেছে। বিএমইটির রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজে গেছেন। ২০২২ সালে শ্রমিক রফতানির সব রেকর্ডই ছাড়িয়ে যাবে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, জনশক্তি রফতানিতেও সুবাতাস বইছে। গত চার মাসে আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় রেকর্ড শ্রমিক দেশের বাইরে গেছেন। তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। ডিসেম্বর মাসে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু হয়নি। বেশ কিছু জটিলতার কারণে শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। দেশের স্বার্থে দ্রুত জটিলতা কাটানোর দাবি জানান তিনি।