নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিতে তৈরি করেছে স্বকীয় অবস্থান। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের শিক্ষা খাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর এর সুফল ভোগ করছে দেশের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা খাতের নানা উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচী। এই কর্মসূচীর আওতায় প্রতিবছর দেশের প্রায় সব স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক। ২০১০ সালে বর্তমান সরকারের নেয়া এই উদ্যোগটি এত ব্যাপকতা পেয়েছে যে মাত্র ১৩ বছরে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪শ’ কোটি বই। সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে এসব পাঠ্যপুস্তক। যা সারা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বিরল দৃষ্টান্ত বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১০ সাল থেকে বই উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন ঘটা করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়া হয়। মহামারী করোনার কারণে গত দুই বছর উৎসব না হলেও বিনামূল্যে বই ঠিকই পেয়েছে দেশের সব শিক্ষার্থী। রাজধানীসহ দেশের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের সব স্কুলেই বছরের প্রথম দিন বিতরণ করা হচ্ছে এসব বই। টানা ১৩ বছর এই কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়াকে মাইলফলক হিসেবে মন্তব্য করছেন অনেকেই। উৎসবের আমেজে বছরের প্রথম দিন খালি হাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নতুন বই হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরছে শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০২২ (চলতি শিক্ষাবর্ষ) সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে মোট ৪শ’ ৩৫ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার ৪১টি বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এসব বই দিতে সরকারের বছর প্রতি খরচ হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই হিসেবে ১৩ বছরে খরচে হিসাব দাঁড়ায় প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এনসিটিবি বলছে, এ কর্মসূচীর শুরুর বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন), মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন), ইবতেদায়ি, দাখিল ও দাখিল (ভোকেশনাল), এসএসসি (ভোকেশনাল) এর মোট ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই। একইভাবে ২০১১ সালে ৩ কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার ৩২১ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ২৩ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ২৩৪টি বই। ২০১২ সালের মোট ৩ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৯ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ২২ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৩টি বই। বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচীতে ২০১৩ সালে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি বই। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন। আর বই বিতরণ করা হয় ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি। একইভাবে ২০১৫ সালে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি বই। ২০১৬ সালে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বই পায় ৩৩ কেটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি।
তবে নতুন করে মাইলফলক শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ বছরই প্রথমবারের মতো অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচীতে যুক্ত করা হয় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাক-প্রাথমিক (৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায়: মারমা, চাকমা, গারো, সাদ্রি ও ত্রিপুরা), এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল (ট্রেড বই), দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক নির্দেশিকা (প্রাথমিক) শিক্ষক শিক্ষাক্রম নির্দেশিকা (মাধ্যমিক) যুক্ত করা হয়। ফলে ওই বছর শিক্ষার্থীদের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বিতরণকৃত বইয়ের সংখ্যাও। মোট ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই। এর ধারাবাহিকতা চলে ২০১৮ সালেও। ওইবছর ৪ কোটি ২৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৩ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দেয়া হয় ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি। একইভাবে ২০১৯ সালে ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই।
২০২০ সালে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণীর জন্য সম্পূরক কৃষি শিক্ষা বইটি। ওই বছর ৪ কোটি ২৭ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৭ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭টি বই।
এর পরপরই বিশ্বজুড়ে আঘাত হানে অতিমারী করোনা। লকডাউন-শাটডাউনে স্থবির হয়ে পরে পুরো বিশ্ব। কিন্তু তবুও চলমান থাকে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বই ছাপার কাজ। তবে এ সময় কমে শিক্ষার্থী এবং বই ছাপানোর সংখ্যাও। এনসিটির মতে, ২০২১ সালে মোট ১ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫৩ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে দেয়া হয় ২৪ কোটি ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫৭টি বই। একইভাবে চলতি শিক্ষাবর্ষের জন্যও বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচী অব্যাহত রাখে সরকার। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই এ বছর মোট ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০টি বই পৌঁছে দেয়া হবে। ১ জানুয়ারি এর প্রায় ৮০ শতাংশ বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেছে। বাকি বইগুলোও চলতি মাসের মধ্যেই পৌঁছে যাবে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। এনসিটিবির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে এমন কয়টি দেশ আছে আমার জানা নেই। আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি এই কর্মসূচী নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে। আশা করছি সুদূর ভবিষ্যতেও এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, এই কর্মসূচী শুরুর আগে দেশে ঝরেপড়া শিক্ষার্থী, স্কুলবিমুখ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল অসংখ্য। সবাইকে একসঙ্গে বিনামূল্যে বই দেয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য যেমন কমছে, দিন দিন বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। আবার ঝরেপড়াও কমছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরে বিনামূল্যে বই দেয়া শুরুর ১২ বছরের মাথায় প্রায় পৌনে দুই কোটির বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। যা অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি আগে শুধু প্রাথমিক স্তরে অর্ধেক বই বিনামূল্যে দেয়া হতো। বাকি বই কিনে পড়তে হতো। আর মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীকে বই কিনতে হতো। তখন শিক্ষার্থীদের সব বই হাতে পেতে পেতে কয়েক মাস চলে যেত। তাদের অনেকে আবার টাকার অভাবে কিনতেও পারত না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের তৈরি হতো। যা এখন আর নেই।
এই কর্মসূচীর মূল উদ্যোক্তা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেছেন, এমন কার্যক্রম পৃথিবীতে খুবই বিরল। আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যখন গিয়েছি তখন দেখেছি এত বিপুল পরিমাণ বই বিনামূল্যে দেয়ার কথা শুনে বিশ্বের বড় বড় দেশের প্রতিনিধিরা অবাক হতেন। সেই সব দেশের কোথাও বিনামূল্যে এত বই দেয়া হয় না।
জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেয়া শুরু করে সরকার। এই কার্যক্রমের ব্যাপ্তি এখন আরও বেড়েছে। এখন প্রাক-প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর (৫টি ভাষায় রচিত তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে বই দেয়া হচ্ছে। যা খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে কখনও কখনও বইয়ের মান এবং বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বড় কোন কাজে এরকম ছোট ছোট বাধা থাকবেই। এগুলোর সমাধানও খুঁজে বের করতে হবে। তবে কোনভাবেই কর্মসূচীতে যেন বাধা না পড়ে সেই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
বিনাম্যূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনেক উপকার হচ্ছে এটি সর্বজন স্বীকৃত উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বিনা মূল্যে বই দেওয়ার আগে দেখা যেত, অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো সব শিক্ষার্থীর বই পেতে জুন পর্যন্তও সময় লেগে যেত। কিন্তু বিনা মূল্যে বই দেওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য কমে গেছে। ঝরে পড়াও কমছে। এখন বছরের শুরুতেই শ্রেণি কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হচ্ছে। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের বড় কারণ বিনা মূল্যে বই দেওয়া।
তবে শিক্ষার্থীরা যাতে শুধু বাধ্যতামূলক শিক্ষা নয় বরং আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে সেই জন্য শিক্ষাক্রম ঢালাও করে সাজানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন, তা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সরকার জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে দক্ষতা ও প্রায়োগিক শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করছে। সে লক্ষ্য অর্জনে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। তিনি জানান, ২০২২ সালে ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলাম পাইলটিং হবে এবং ২০২৩ সাল থেকে নতুন পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করা হবে। শিক্ষাব্যবস্থার সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, দেশে দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টি করতে সরকার কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যা দেশকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।