নিউজ ডেস্ক:
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান এবং তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার সরাসরি জড়িত। সরকারের মদদ না থাকলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ঘটানো সম্ভব হতো না। বিএনপি সরকার যদি এর সঙ্গে জড়িত না-ই থাকবে তাহলে তারা আলামতগুলো কেন নষ্ট করবে? গতকাল ভয়াল একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। এ সময় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, মহানগর ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ২১ আগস্ট নিহতদের স্মরণে দলীয় কার্যালয়ের নিচে স্থাপিত বেদিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটায়। এর সঙ্গে তার ছেলে তারেক রহমান যে জড়িত সেটাও এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের কথায় বেরিয়ে এসেছে। তারা কোথায় মিটিং করেছে, কীভাবে এই ষড়যন্ত্র করেছে জড়িতরা বলেছে। আসলে আমি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের টার্গেটে ছিলাম। বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু করার জন্যই আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাছাড়া ২১ আগস্টের ঘটনায় আমার বাঁচার কথা নয়। তিনি বলেন, মোহাম্মদ হানিফ ভাইসহ আমাদের নেতা-কর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে সেদিন আমাকে রক্ষা করেছিলেন। আমি জানি না, এরকম অবস্থায় পড়ে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে কিনা। আল্লাহ বোধ হয় হাতে তুলে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এই সন্ত্রাসীদের এক জায়গায় করা, তাদের ট্রেনিং দেওয়া, তাদের আনা, পরবর্তীতে তাদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাদের মনে হয়েছিল, আমি মারা গেছি। যখন শুনেছে আমি মারা যাইনি তখন তাদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ওই হামলাকারীরা যাতে নির্বিঘ্নে ওই এলাকা ত্যাগ করতে পারে সেই সুযোগটা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছিল। কাজেই সরকারের মদদ না থাকলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এভাবে হতে পারে না।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি সরকার যদি এর সঙ্গে জড়িত না-ই থাকবে তাহলে তারা আলামতগুলো কেন নষ্ট করবে? ওই গ্রেনেড হামলার পরেই সিটি করপোরেশনের তখনকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা তার লোকজন নিয়ে এসে পুরো এলাকা ধুয়ে ফেলে। তিনি বলেন, আর যে গ্রেনেডটা ওখানে পাওয়া গিয়েছিল একটা রমনা ভবনের কোনায়, আরেকটা ওই স্পটেই ছিল বিস্ফোরিত হয়নি। আরেকটা বিস্ফোরিত হয়েছে আমি যখন ওখান থেকে চলে আসি গাড়ি নিয়ে ঠিক তার পরেই। সেই গ্রেনেডটা একজন সেনা অফিসার আলামত হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন বলে খালেদা জিয়া তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল। কোনো আলামতই তারা রাখতে চায়নি। তারপর আপনারা জানেন একটা নাটক সৃষ্টি করে। হত্যাকান্ডের সঙ্গে খালেদা জিয়া জড়িত মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, যখন কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল তার আগে বলেছিল যে, আওয়ামী লীগ ১০০ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছিল, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধীদলীয় নেতাও কোনো দিন হতে পারবে না। এই ভবিষ্যৎ বাণী খালেদা জিয়া কীভাবে দিয়েছিল? কারণ তাদের চক্রান্তই ছিল যে, আমাকে তারা হত্যা করে ফেলবে তাহলে তো আমি কিছুই হতে পারব না। প্রতিটি ঘটনার আগে তার বক্তৃতা যদি আপনারা অনুসরণ করেন তাহলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।
২১ আগস্টের ঘটনা নিয়ে সংসদে তৎকালীন বিরোধী দলকে কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি জানিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অনেক সংসদ সদস্যই এই গ্রেনেড হামলায় আহত। আমরা যখন এটার ওপর আলোচনা করতে চাইলাম। একটা রেজ্যুলেশন নিতে চাইলাম অপজিশন থেকে-খালেদা জিয়া কিন্তু সেটা হতে দেয়নি। আলোচনা করতে দেয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশে এ রকম একটা ঘটনা ঘটে গেছে, আমি বিরোধী দলের নেতা। আমার ওপর এই রকম গ্রেনেড হামলা। বিরোধী দলে- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো একটি দল, যে দল স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। সেই দলের সভায় এই রকম গ্রেনেড হামলা। আর পার্লামেন্টে যিনি সংসদ নেতা, বলে দিল ওনাকে আবার কে মারবে? তখন তো বলতে হয় আপনিই তো মারবেন। চেষ্টা করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, সেই জন্য আর পারছেন না। এই রকম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আমাদের কোনো কথা বলতে দেয়নি এই হামলা সম্পর্কে। তিনি বলেন, সংসদে কথা বলতে আমাদের কাউকে মাইক দেয়নি। আলোচনা করতে দেয়নি। এতে কী প্রমাণ হয়? তারা যদি সরাসরি জড়িত না থাকত তাহলে কি তারা এতভাবে বাধা দিত।
গ্রেনেড হামলায় আহতদের চিকিৎসায় বাধা দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যখনই গ্রেনেড হামলাটা হলো, সাধারণত একটা সভ্য দেশ হলে কী করত- সঙ্গে সঙ্গে পুলিশসহ অন্যান্য সবাই ছুটে আসত আহতদের সাহায্য করতে, উদ্ধার করতে, চিকিৎসা করতে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, সেখানে কোনো রোগী ঢুকতে পারবে না, যেতে পারবে না, চিকিৎসা নিতে পারবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিএনপির কোনো ডাক্তার সেখানে উপস্থিত নেই। যাদের ডিউটি ছিল তারাও নেই। কারণ, রোগীদের চিকিৎসা করবে না। আমাদের যারা ডাক্তার তারা সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা শহরে কত হাসপাতাল, কত ক্লিনিক আছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বোধ হয় আমরা জানতে পারি। সমগ্র ঢাকা শহরে নেতা-কর্মীরা যে যেখানে পেরেছে তাকে সেখানে নিয়ে গেছে।
আহতদের সাহায্য করতে আসা নেতা-কর্মীদের তা করতে দেওয়া হয়নি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা দূরে ছিল তারা যখন ছুটে আসে পুলিশ তাদের টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে, লাঠিপেটা করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।
গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, এ ধরনের গ্রেনেড হামলা বোধ হয় পৃথিবীতে আর কখনো কোথাও ঘটেনি। সাধারণত রণক্ষেত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের সেই র্যালিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং আমাকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ঘটনাটা ঘটিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু সেদিন আইভী রহমানসহ আমাদের ২৪ জন নেতা-কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন। সেই সঙ্গে অনেক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়ে পথে মারা গেছেন।
মানুষের জন্য কিছু করতেই আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে তারা একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আমি জানি না আল্লাহ কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য যাতে কিছু করতে পারি সেই জন্যই হয়তো বাঁচিয়ে রেখেছেন। নইলে এ রকম অবস্থা থেকে বেঁচে আসা অত্যন্ত কষ্টকর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে বহুবার বিভিন্ন হামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ হামলা হতে বেঁচে যাওয়া নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিছু কাজ রেখে দিয়েছেন, সেটা সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত হয়তো কাজ করে যেতে পারব। আল্লাহ সেই সুযোগ দেবেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন অভিযোগ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমি আমাদের নেতা-কর্মীদের ও দেশবাসীকে স্মরণ করাতে চাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, তাদের ইনডেমনিটি দেওয়া হয়, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। ওই চক্রান্তের সঙ্গে খন্দকার মোশতাক যেমন জড়িত, সেই সঙ্গে জিয়াউর রহমান গং, তারাও জড়িত। কারণ খন্দকার মোশতাক অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধান করে। আবার জিয়াউর রহমানই সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয় এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা, যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, একটা পরিবারকে হত্যা করেছে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস করেছে, তাদেরকেই বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়, পুরস্কৃত করে। তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠতাও ছিল। খুনি কর্নেল রশিদ-ফারুক বিবিসির ইন্টারভিউয়ে খুব স্পষ্টভাবে বলেছে। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খুনিদের যে সম্পর্ক ছিল, এটা তো আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
আমেরিকায় জয়কে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখানেই (২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা) তারা ক্ষান্ত হয়নি। আমেরিকায় আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে কিডন্যাপ করে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সেখানে তারা ধরা পড়ল কার কাছে? মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর তদন্তে এটা বের হয়। তারা যখন এটা তদন্ত করে সেখানে বিএনপির নেতা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে যে রায় দেয় বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান এবং শফিক রেহমান তাদের নাম বেরিয়ে এসেছে যে, তারা এর সঙ্গে জড়িত। যে শাস্তি পায় সে তারেক জিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে এই ঘটনা ঘটিয়েছিল, জয়কে যে হত্যা (চেষ্টা) করবে এটা আমরা কখনো জানতে পারতাম না যদি এফবিআই এটা খুঁজে বের না করত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা সংকটকালে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগসহ প্রতিটি সহযোগী সংগঠন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ধান কাটার সময় তারা ধান কেটে কৃষকের ঘরে তুলে দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এখনো ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষকে এই ত্রাণ দিতে গিয়ে দলের অনেক নেতাকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। করোনার সময় পুলিশ, বিজিবি ও প্রশাসনের সবাই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আর দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আর কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা এভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি।
সূত্র: পাবনা সমাচার