নিউজ ডেস্ক:
দেশে ব্যাপক হারে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকায় পাল্লা দিয়ে রোগীদের চিকিত্সা সেবাও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে সরকার। ২০০ শয্যার অত্যাধুনিক আইসিইউ নিয়ে একটি কোভিড হাসপাতাল চলতি সপ্তাহেই চালু হচ্ছে। মহাখালীর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটেই হচ্ছে এই হাসপাতাল। একই সঙ্গে এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১ হাজার সাধারণ শয্যাও চলতি মাসের মধ্যে চালুর বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে।
গতকাল রবিবার সরেজমিনে মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে গিয়ে কোভিড-১৯ হাসপাতাল প্রস্তুতের কার্যক্রম দেখা যায়। সেখানে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা বলেন, সব কাজই এখন শেষ পর্যায়ে। এই হাসপাতাল চালুর মধ্য দিয়ে কোভিড রোগীদের চিকিত্সা সেবা নিয়ে দুর্ভোগ কমে যাবে। একই সঙ্গে সেখানে বিশ্বমানের ২০০ বেডের আইসিইউর প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। এদিকে রাজধানীর ১৪টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আরো ২১৪০ বেড চালু করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড পুরো বিশ্ব। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। করোনা রোগীদের চিকিত্সা সেবা দিতে গিয়ে অনেক উন্নত দেশও হিমশিম খাচ্ছে। রোগীর চাপ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে আমেরিকা-ইউরোপের মতো দেশেও আইসিইউয়ে চিকিত্সাধীন থাকা ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের সরিয়ে তরুণদের চিকিত্সা সেবা দেওয়া হয়েছে। অর্থাত্ সবার চিকিত্সা সেবা দেওয়া অনেক দেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখনো অনেক দেশ সক্ষমতা বাড়াতে পারিনি। আবার অনেক দেশ সক্ষমতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশও সক্ষমতা বাড়াতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম গা-ছাড়া ভাব ছিল, তবে এখন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় ২০০ শয্যার অত্যাধুনিক আইসিইউ এ সপ্তাহের চালু হচ্ছে। মহাখালীর এই কোভিড হাসপাতাল স্থায়ীভাবে থাকবে। সেখানে শুধু করোনা রোগীদের চিকিত্সা সেবা দেওয়া হবে।
গতকাল এই প্রতিনিধি সরেজমিনে চালু হতে যাওয়া হাসপাতালটি পরিদর্শন করে দেখতে পান, দ্রুত সব কিছু ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে এই হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন ইত্তেফাককে জানান, চলতি সপ্তাহে এই কোভিড হাসপাতাল চালু করা হবে। প্রথমে ৫০ বেডের আইসিইউ দিয়ে শুরু হবে। দ্রুত আরো ১৫০ শয্যার আইসিইউ চালু করা হবে। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১০০০ সাধারণ বেড চলু করা হবে। জনবল, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে লিখিতভাবে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আগে এটি হাসপাতাল ছিল বলে অনেকে নানা অপপ্রচার করছে। যা মোটেও ঠিক না। একই কথা বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপিও।
করোনা রোগীদের জন্য রাজধানীতে ২১৪০টি বেড ইতিমধ্যে চালু করা হয়েছে। এরমধ্যে মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১৫০ বেড, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটে ১০০ বেড, শ্যামলীর টিবি হাসপাতালে ১৫০ বেড, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ১০০ বেড, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাপসাতালে ১০০ বেড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৫০ বেড, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৮০ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২০০ বেড, কুয়েত- মৈত্রী হাসপাতালে ৪৬ বেড, মহাখালী সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালে ৫০ বেড, পুরান ঢাকার মহানগর হাসপাতালে ১৫০ বেড, মিরপুর লালকুঠি হাসপাতালে ২০০ বেড ও মিডফোর্ড হাসপাতালে ৭০ বেড করোনা রোগীদের জন্য চালু করা হয়েছে।
করোনার প্রথম ঢেউ যখন ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছিল, তখন বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে করোনা রোগীদের জন্য একটি হাসপাতাল করা হয়েছিল। সেখানে তাঁবু বসিয়েছিল বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ, আর যন্ত্রপাতি ও জনবল ছিল সরকারের। কিন্তু করোনা মহামারি কমে যাওয়ায় ঐ হাসপাতালে শয্যা ফাঁকা থাকছিল। এছাড়া বসুন্ধরা হাসপাতালে রোগীরা যেতে চাইতো না। তাঁবুর কারণে প্রচন্ড গরমে যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হওয়ায় সেসব যন্ত্রপাতি দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জনবল প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আর বসুন্ধরা তাদের তাঁবু সরিয়ে নেয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এগুলো নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। সরকারের আর্থিক কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে করোনা হাসপাতাল চালুর করা হচ্ছে। সেইভাবে অবকাঠামো তৈরি করছি। সেখানে ২০০ বেডের আইসিইউ হবে, ১০০০ সাধারণ শয্যা থাকবে। এটি আগে কোন হাসপাতাল ছিল না। কোভিড হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তার-নার্সদের জন্য ওপরের ফ্লোরে বিশ্বব্যাংক তাদের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০ বেডের হাসপাতাল করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটি আর চূড়ান্ত হয়নি। এসব নিয়েও কোন কোন মহল মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, কোভিড রোগীদের চিকিত্সা সেবার সম্প্রসারণ হচ্ছে দ্রুত। যাতে রোগীদের চিকিত্সা সেবা ব্যাহত না হয়। তিনি বলেন, করোনা রোগীদের জন্য বসুন্ধরায়
এদিকে করোনা আবহে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রতিদিন নতুন রেকর্ড গড়ছে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে করোনা ভাইরাসে গত একদিনে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা দৈনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ যাবত্কালের মধ্যে সর্বাধিক। শনিবার একদিনে ৭৭ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই দিন পর্যন্ত সেটিই ছিল একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর রেকর্ড, যা এক দিনের মাথায় ভেঙে গেল। এর মাধ্যমে দেশে মোট ৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৩৯ জন। গত ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর থেকে দৈনিক মৃত্যু কখনোই ৫০ এর নিচে নামেনি।
তবে নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা ৬ হাজারের নিচে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৮১৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৬ জন। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত কয়েক দিন ধরেই দিনে ৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়ে আসছিল। এর মধ্যে গত বুধবার রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়।
গতকাল বিকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেটের সচিবালয় অংশের সংগনিরোধক ব্যয়খাত থেকে করোনার আপদকালীন সময়ে ঢাকাসহ দেশের তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৪৮৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুকূলে ৩ লাখ টাকা করে মোট ১৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এই টাকা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ব্যবস্থাপনায় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি (লজিস্টিক সাপোর্ট), রোগীদের পথ্য, ঔষধ সামগ্রী, কেমিকেল-রি-এজেন্ট (এক্সরে ফিল্ম, ইসিজি পেপারসহ) ক্রয় খাতে ব্যবহূত হবে। বিকালে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সুশীল কুমার পাল স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রের মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়েছে।