নিউজ ডেস্ক:
বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে বড় রফতানি বাজার। বাংলাদেশ হালাল পণ্য উৎপাদন ও রফতানির সবচয়ে বড় অংশীদার হতে পারে। অতি সম্ভাবনাময় হালাল পণ্য খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্যের হাতছানি দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এই সুযোগ গ্রহণ করতে হলে হালাল নীতি-কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি হালাল মান ও সনদ প্রদানের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ হাইকমিশন, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে প্রেরিত এক চিঠিতে জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে হালাল পণ্য রফতানি কার্যক্রম গতিশীল করা প্রয়োজন। অন্যথায় হালাল পণ্য রফতানিতে পিছিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকোনমিক উইং থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, জরুরীভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত হালাল খাদ্য পণ্য সংক্রান্ত গৃহীত পদক্ষেপ এবং হালনাগাদ তথ্যাদি সৌদি আরব জানতে চেয়েছে।
জানা গেছে, হালাল পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বতর্মানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগ থেকে সনদ নিয়ে থাকে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া হালাল সনদ নীতিমালা ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ যে সার্টিফিকেট ইস্যু করছে তা অনেক দেশই গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। সম্প্রতি সৌদি আরব সরকার খাদ্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশের কাছে দেশটি খাদ্য পণ্য সংক্রান্ত হালাল সনদ এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানতে চেয়ে সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে। সন্তোষজনক জবাব না পাওয়া গেলে সৌদি আরবে খাদ্য পণ্যসহ অন্য পণ্যসামগ্রী রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশীয় ১১৫টি প্রতিষ্ঠান ৩০০ রকম পণ্য রফতানির অনুক‚লে হালাল সার্টিফিকেট নিয়েছে। অথচ আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করে সার্টিফিকেট প্রদান করা সম্ভব হলে এই রফতানি পণ্যের সংখ্যা কয়েক হাজার হতো বলে মনে করা হচ্ছে। হালাল খাদ্যের পাশাপাশি প্রসাধনী, পোশাকসহ হাজার পণ্যসামগ্রী রফতানি হতে পারে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসিরসহ বিভিন্ন দফতরের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাইপূর্বক হালাল সনদ প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে হালাল সনদ বিভাগের পরিচালক মোঃ লুৎফর রহমান সরকার অধিদফতরের ওয়েবসাইটে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যেমন ভোক্তাদের হালাল সনদ দেখে পণ্য কেনার আগ্রহ রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন দেশে সনদ ছাড়া ভোগ্যপণ্য বাজারজাত করার সুযোগও সীমিত। এ অবস্থায় দেশী-বিদেশী চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য বিদেশে রফতানি ও জনপ্রিয় করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত হালাল সনদ নীতিমালার আলোকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগ থেকে হালাল সনদ ইস্যু করা হয়। এ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ১১৫টি কোম্পানির অধীনে ৩০০টি পণ্যের অনুক‚লে হালাল সনদ ইস্যু করা হয়। ২০০৭ সালে এ বিভাগের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
হালাল পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর যৌথভাবে কাজ করবে ॥ হালাল পণ্য রফতানি করে বছরে এ খাতে আয় হচ্ছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। তবে নীতিগত সহায়তা বাড়িয়ে আগামী দশ বছরের মধ্যে এই আয় দশগুণ বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। হালাল খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর যৌথভাবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ সংক্রান্ত একটি অনুষ্ঠানে তিনি জানান, বাংলাদেশ হালাল খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের নতুন প্রযুক্তি ও সহযোগিতা হালাল খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ যৌথভাবে হালাল খাদ্য উৎপাদনে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে কাজ করতে পারে। দ্বি-পক্ষীয় ওই আলোচনাকালে সিঙ্গাপুরের ট্রেড রিলেশনস মিনিস্টার যৌথভাবে বাংলাদেশে হালাল খাদ্য উৎপাদন, বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশ রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণে কাজ করছে। বিশ্ববাজারে হালাল খাদ্যের একটি বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্ববাজারে প্রায় ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের হালাল পণ্যের বাজার সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে দুনিয়াজুড়ে হালাল পণ্যের চাহিদা বাড়লেও তাতে উল্লেখযোগ্য হারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব নেই বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার। তাই হালাল পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে বাংলাদেশের এখনই প্রস্তুতি নেয়া দরকার বলে মনে করছে সংগঠনটি। হালাল পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পিছিয়ে পড়েছে, এগিয়ে রয়েছে ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও থাইল্যান্ড।
মালয়েশিয়ার আদলে কর্তৃপক্ষ গঠনের পরামর্শ ॥ হালাল পণ্য রফতানি বাড়াতে মালয়েশিয়ার আদলে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে প্রেরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশে হালাল পণ্য ও সেবার মান বৃদ্ধি বিষয়ক কৌশলের কারণে বিশ্বে হালাল বাণিজ্য দ্রæত প্রসার লাভ করছে। দিনার স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত স্টেট অব দ্য গেøাবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০২০-২১ থেকে জানা যায়, ২০২৪ সাল নাগাদ হালাল পণ্য রফতানি ও সেবা খাত থেকে আয় ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০১৯ সালে বিশ্ববাণিজ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্যেও হালাল বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি ছিল প্লাস ৩ দশমিক ২ শতাংশ। সম্প্রতি হালাল পণ্যের চাহিদা শুধু ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াতে ক্রমশ প্রসার লাভ করেছে। দূতাবাসের ওই চিঠিতে আরও বলা হয় বর্তমানে বাংলাদেশের রফতানি আয় জিএসপি সুবিধানির্ভর। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে জিএসপি সুবিধা উঠে গেলে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা রয়েছে তা মোকাবেলা করার উত্তম বিকল্প হয়ে উঠতে পারে হালাল পণ্য রফতানি সম্প্রসারণ। এক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে সরকারী প্রয়াসে একটি শক্তিশালী হালাল ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা। হালাল নীতি-কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি হালাল মান ও সনদ প্রদানের জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মালয়েশিয়ায় হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের কাজটি করছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন পরিচালিত ডিপার্টমেন্ট অব ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট মালয়েশিয়া (জেএকেআইএম)। মালয়েশিয়ার সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আলাদা একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে হালাল পণ্য রফতানি কার্যক্রম গতিশীল করা যেতে পারে।
সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন, বাংলাদেশে হালাল বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে হালাল-৩৬০ কানেক্টিং ইউর বিজনেস টু দ্য হালাল ইকোসিস্টেম শীর্ষক এক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এ সভায় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার শীর্ষ হালাল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং উভয় দেশের শতাধিক ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। ওই সভা শেষে সবাই হালাল সার্টিফিকেশনে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া গত ১০ আগস্ট সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকোনমিক উইং থেকে ইকোনমিক কাউন্সিলর মুর্তুজা জুলকার নাঈম নোমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, সৌদি আরবে রফতানিকারক বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল খাদ্যপ্রস্তুতকারী কারখানাগুলোকে সৌদি আরবের ফুড হাইজিন রিকয়্যারমেন্টসসমূহ মেনে চলতে হবে। এ পর্যন্ত গৃহীত পদক্ষেপ এবং হালনাগাদ তথ্যাদি বাংলাদেশ দূতাবাসকে জরুরীভিত্তিতে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে, সুস্বাদু হওয়ায় বাংলাদেশের গরুর মাংসের চাহিদা বিশে^ সবচেয়ে বেশি। মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে এই মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ অনেক দেশ মাংস আমদানির বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত সার্টিফিকেশন বিষয়টির কারণে আর রফতানির প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেয়া যায়নি। ব্যাপক চাহিদা থাকায় কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ৩৮ ধরনের সবজি, ২৯টি মসলা জাতীয় পণ্য এবং প্রাণিসম্পদ সম্পদ অধিদফতর ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে আরও ১৭টি পণ্য রফতানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশী বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফলেরও চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। হালাল পণ্য রফতানিতে বেঙ্গল মিট, প্যারাগন ফ্রোজেন ফুড, কাজী ফার্মস এবং সিপি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড প্রথম সারিতে রয়েছে। এই চার প্রতিষ্ঠানেরই বছরে রফতানির পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি ফলমূল ও শাক-সবজি রফতানি হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, আগামী দশ বছরে হালাল ফুড রফতানি দশগুণ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও ৫টি সরকারী-বেসরকারাী সংস্থার উদ্যোগে একটি সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণের জন্য কাজ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করবে পররাষ্ট্র, কৃষি, ধর্ম, তথ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর পাশাপাশি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বিএসটিআই, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, এফবিসিসিআই ও জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর হালাল পণ্য রফতানি বাড়ানোর পদক্ষেপে সরাসরি যুক্ত থাকবে।