বিপ্লব বিজয় তালুকদার
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সকালে টিভিতে এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান দেখে বেশ কিছু স্মৃতি মনে আসতে শুরু করল। আমাদের পরিবারে চারজন শিক্ষক আর একজন লাইব্রেরিয়ান। তাদের মধ্যে পথিকৃত হচ্ছেন আমার জ্যেঠা, সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রী ব্রজেন্দ্র কুমার তালুকদার। আট বছর আগে তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেছেন।
সুনামগন্জের ধর্মপাশা, মধ্যনগরের অজপাড়াগাঁয়ে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনি জ্ঞানী ছিলেন, সদালাপী ছিলেন। তেজস্বীও ছিলেন, অন্যায়কে কখনও প্রশ্রয় দেননি। খুব অল্প বয়সেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের ব্রতই ছিল মানুষ তৈরি করা, দেশের জন্য, জাতির জন্য ভাল মানুষ তৈরি করা। তিনি ত্যাগের প্রতীক ছিলেন। পরিবারের সকলের চিন্তায় তিনি আমৃত্যু কৃচ্ছতাসাধন করেছেন। কখনই আভিজাত্য তাঁকে স্পর্শ করেনি। প্রায় চল্লিশ বছর বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতা করে যে সকল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তা যখন বলতেন তখন মনে হত ঘটনাটি যেন আমার সামনেই ঘটেছে। দারুণ বক্তৃতা দিতে পারতেন। তিনি বলতেন “আমি তিন যুগের শিক্ষক; ব্রিটিশ পিরিয়ডে তার শৈশব, পাকিস্তান পিরিয়ডে তার যৌবন আর বাংলাদেশ পিরিয়ডে তার বার্ধক্য।” আমাদের কনস্টিটিউয়েন্সির একজন পার্লামেন্টারিয়ান তাঁর ছাত্র ছিলেন, তিনি আমার জ্যেঠাকে সালাম দিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করতেন। দু/তিনবার এমপি ছিলেন তাঁর সেই ছাত্র।জ্যেঠার স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। কোন ছোট ঘটনাও তিনি ভুলতেন না। রবীন্দ্র, নজরুলের অনেক কবিতা, গীতার শ্লোক তিনি যেকোন পরিস্থিতিতে আওড়াতে পারতেন। চমৎকার অভিনয় করতেন। রাজা হরিশ্চন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি নিজে কেঁদেছেন, অগণিত দর্শক শ্রোতাদের অঝরে কাঁদিয়েছেন। আমার চাকরিজীবনের চড়াই উৎরাই নিয়ে তিনি খুব শঙ্কিত ছিলেন। আমার জীবনের শিক্ষাগুরু, ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে কখনো আমার কোন কর্মস্থলে নিয়ে যেতে না পারার (ততদিনে শারীরিকভাবে অসুস্থ) কষ্ট হয়ত কোনদিন কোনকিছু দিয়ে কম্পেনসেইট করতে পারব না।
আরেকজন শিক্ষক, যাঁকে আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম, জনাব রুস্তম আলী। ছাত্রদের জন্য এমন নিবেদিত আদর্শবান শিক্ষকের কথা বর্তমান ছাত্রদের নিকট শুনিনা। বৃত্তি পরীক্ষায় সকল অংক সঠিক হওয়ার আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন এমন আবেগপ্রবণ শিক্ষক এখন ক’জন আছেন খুব জানতে ইচ্ছে করে। অথচ এর বিপরীতে এখন দেখি কিছু শিক্ষক স্কুলে ছাত্রদের সময় দেননা, কিছু শিক্ষকের যৌন হয়রানির সাথে সম্পৃক্ততা, অর্থলিপ্সা, এমনকি শিক্ষককে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস থেকে বের করে নিয়ে আসতে হয়। এসব দেখে হতাশা ভর করে। আবার দেখেছি পুলিশ লাইনস্ স্কুল এন্ড কলেজ, নাটোর এর ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক দিবসের আগেই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেক কেটে, চকলেট উপহার দিয়ে অগ্রিম শিক্ষক দিবস পালন করেছে। যা খুবই অনুপ্রেরণাব্যঞ্জক।
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয়, শিক্ষকরা মেরুদন্ড শক্ত করার কারিগর। ছাত্রছাত্রীরা যাতে শিক্ষা গ্রহণে আনন্দ উপভোগ করে, শিক্ষা প্রদানে শিক্ষকদের সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত। শিক্ষাই আলো, শিক্ষাই সকল অন্ধকার দূর করে। শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। শিক্ষক দিবসে আমার সকল শিক্ষকগণের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি। এই মহান পেশায় নিয়োজিত সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: উপ কমিশনার, ডিএমপি ও সাবেক পুলিশ সুপার, নাটোর
ফেসবুক টাইমলাইন থেকে, ৫ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার