নিউজ ডেস্ক:
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১২ দিন পার হচ্ছে আজ (৮ মে)। ২৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পর সেখানেই তার চিকিৎসা চলছে। পাশাপাশি আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়ার আবেদন করেছে তার পরিবার। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। তবে, শারীরিক অবনতির বিষয়টি সামনে রেখে দণ্ড মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে ‘স্বাধীনভাবে’ চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দিতে পারে সরকার। বিএনপির ঢাকা ও লন্ডনের একাধিক উচ্চপর্যায়ের সূত্রে এমন আভাস মিলেছে।
উচ্চপর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত জটিলতা দিনে-দিনে বেড়ে যাওয়ায় তার দণ্ড মওকুফের চিন্তা করা হচ্ছে উচ্চপর্যায় থেকে। তার উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে ইতোমধ্যে বাংলা ট্রিবিউন-এর সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক। কাল রবিবার (৯ মে) তার মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছাবে বলেও জানান তিনি।
বিজ্ঞাপন
আইন বলছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করতে পারে সরকার। ৪০১-এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি কোনও অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোনও সময় বিনাশর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয় সেই শর্তে তার দণ্ড স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারবে।
সূত্রগুলো জানায়, গতবছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের শর্তসাপেক্ষ মুক্তির পেছনেও মানবিক বিষয়টি বিবেচনা করেছিল সরকার। আর এখন তিনি যখন পোস্ট-কোভিড সমস্যায় আক্রান্ত এবং তার শারীরিক অবস্থার জটিলতার অবসান হয়নি, সেক্ষেত্রে সরকার তাকে স্বাধীনভাবে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেবে বলেই আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির উচ্চপর্যায়ে সরকারের এ অবস্থানের কথা পৌঁছেছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘৪০১ ধারায় চাইলে সরকার তার দণ্ড কমাতে পারে, শর্তসাপেক্ষ মুক্তি দিতে পারে, দণ্ড মওকুফ করে মুক্তিও দিতে পারে।’
জানতে চাইলে শনিবার বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাল নথি যাবে। কী মতামত দিয়েছি সেটা তারাই হয়তো জানাবেন।’
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা (কারাদণ্ড) হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে তার ছয় মাসের মুক্তি হয়। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ায় সরকার। এ বছরের মার্চে তৃতীয়বারের মতো ছয় মাসের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
২৭ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়া
শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল: ডা. জাহিদ
শনিবার (৮ মে) বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে খালেদা জিয়ার অন্যতম চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল আছে।’ এর বেশি কিছু বলেননি তিনি।
২৭ এপ্রিল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালেই সার্বক্ষণিক খালেদা জিয়ার চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জাহিদ হোসেন।
হাসপাতালে ১২ দিন
গত ১১ এপ্রিল করোনা পরীক্ষায় পজেটিভ রিপোর্ট আসে খালেদা জিয়ার। সেদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিকালে সাংবাদিকদের জানান এ খবর। এরপর অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী, অধ্যাপক ডা. শাকুর, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ডা. আল মামুন ও তার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমানের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা শুরু হয়।
এরপর ১৫ এপ্রিল সিটিস্ক্যান করাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় খালেদা জিয়াকে। পরীক্ষা করিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন।
এরপর চিকিৎসকরা প্রাত্যহিক দেখাশোনা করে নিয়মিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। কোভিড রোগীর যেসব লক্ষণ থাকে, সেগুলো নেই। তবে, এরইমধ্যে আবারও দুই দফা করোনা পরীক্ষায় পজেটিভ আসে বিএনপি প্রধানের।
এরমধ্যে শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি দেখা না দিলে ২৭ এপ্রিল আবার তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে এভারকেয়ারে নেওয়া হয়। পরে সেদিন রাতেই তাকে সেখানে ভর্তি করানো হয়। ২৮ এপ্রিল ব্যক্তিগত ও এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। সেদিন ডা. জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) যে চিকিৎসা বাসায় চলছিল, সেই চিকিৎসাসহ সেখানে আরও কিছু নতুন ওষুধ যুক্ত করা হয়েছে। উনি (খালেদা জিয়া) এখন স্টেবল।’
এরপর তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিতে তোড়জোর শুরু হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে খালেদা জিয়ার পরিবার। কদিন পর ৩ মে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিলে সেদিন বিকালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয় খালেদা জিয়াকে। সেদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৪ মে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত পরীক্ষার রিভিউ করে মেডিক্যাল বোর্ড।
৫ মে রাত সাড়ে আটটার দিকে খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমণ্ডির বাসায় লিখিত চিঠি নিয়ে যান তার ভাই শামীম এস্কান্দার। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ মে খালেদা জিয়ার করোনা পরীক্ষা নেগেটিভ আসে। সেদিন সকালে মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়া পোস্ট-কোভিড জটিলতায় ভুগছেন। মানবিক কারণে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান তিনি। ৭ মে (শুক্রবার) সন্ধ্যার পর ডা. জাহিদ হোসেন জানান, সরকারের অনুমতি পাওয়ার পর মেডিক্যাল বোর্ডে পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি এও জানান, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের মতোই স্থিতিশীল।
বিএনপির লন্ডনের নেতারা কী বলছেন?
বিএনপির লন্ডনের নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া লন্ডনে তার পুত্র তারেক রহমানের পরিবারের সঙ্গে থাকতে ও সেখানেই চিকিৎসা নিতে পছন্দ করছেন। তবে করোনাভাইরাসের কারণে লন্ডনে বাংলাদেশ থেকে আসলে ১৪ দিনের আবাসিক কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম চালু থাকায় আপাতত তৃতীয় কোনও দেশে চেকআপ করাতে পারেন তিনি।
এ ছাড়া, লন্ডনের স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমতিসহ বিভিন্ন কিছু কারণে আরও কিছু সময় লাগবে বলেও একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে আগেই জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার (৬ মে) যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসার ক্ষেত্রে ব্রিটেনে হোটেল কোয়ারেন্টাইন বিদ্যমান থাকলেও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও একজন রোগী হিসেবে বেগম জিয়া কী সুবিধা পাবেন তা পরিবারের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’
২০১৭ সালের ১৬ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান খালেদা জিয়া। সেখান থেকে এক মাসের মধ্যেই ফেরার কথা থাকলেও দেশে ফিরতে দেরি হয়। ওই বছর ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরেন তিনি।