নিউজ ডেস্ক:
অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। এত প্রাণ, রক্ত ও সল্ফ্ভ্রমের বিনিময়ে আর কোনো জাতিকে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের মহান নেতার নির্দেশে ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে’ আমরা একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক সর্বস্ব বাজি রেখে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমার কত সহযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি। আমরা অনেকে অমূল্য স্বজন ও সম্পদ হারিয়েছি। তাই এই স্বাধীনতা আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা দিবসে আমি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি স্বাধীন বাংলাদেশের এই মহান স্থপতিকে। আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থক, বিদেশি বন্ধুসহ সকল স্তরের জনগণকে, যারা আমাদের অধিকার আদায় ও মুক্তিসংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।
স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আমার নিজের কাছেও নিছক ‘তাত্ত্বিক’ বিষয় নয়। একাত্তরের উত্তাল মার্চ বা তার আগে ও পরের দিনগুলোতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা বঙ্গবন্ধুর বাঁশির সুরে আমার মতো কোটি কোটি বাঙালি স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখেছিল। মনে পড়ে, মার্চের উত্তাল দিনগুলোর কথা। আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কিশোরগঞ্জে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা মাঠে ছাত্র জনসভায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করি।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওই দিন সকালেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে কিশোরগঞ্জে সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি ও আমার সহকর্মীরা। আমরা গঠন করি সংগ্রাম কমিটি। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ব্যয় নির্বাহের জন্য বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এপ্রিলের প্রথম দিকে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ও বাজিতপুর শাখা থেকে কমবেশি ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ওই সময় নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায় জমা রাখি আমরা।
এপ্রিলের দিকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন আমরা কিশোরগঞ্জ আর নিরাপদ মনে করিনি। আমি যেহেতু সত্তরের নির্বাচনে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম, আমার ঝুঁকি ছিল আরও বেশি। এ ছাড়া সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে হলে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রও প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত নিই ভারতে যাব। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত পার হয়ে আগরতলায় চলে যাই। গিয়ে দেখি, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লার অধিকাংশ নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ সেখানে অবস্থান করছেন। আমি তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করি। একই সঙ্গে আগরতলায় ভারতের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করি।
এপ্রিলের শেষ দিকে সুযোগ বুঝে আবার সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসে আরও কিছু সহযোগীকে একত্র করি। তাদের সঙ্গে আবার ভারতের মেঘালয় রাজ্যের টেকেরহাট, গুমাঘাট, পানছড়া, মৈইলাম হয়ে বালাট পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্য ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প চালু করি। আমি ছিলাম ওই ক্যাম্পের চেয়ারম্যান। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সীমান্ত পাড়ি দিত, তাদের প্রাথমিক বাছাই কাজ ওই ক্যাম্পে করা হতো।
পরবর্তী সময়ে মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয় জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল। আমি ছিলাম এর অন্যতম সদস্য। এ ছাড়া মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হিসেবে তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনীর সাবসেক্টর কমান্ডার পদসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। মেঘালয়ে অবস্থানকারী শরণার্থীরা যাতে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে ও উৎসাহের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করতে পারে, সে জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে সভা করতে থাকি। এর মধ্যে দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন- এই ভাবনা দূর হচ্ছিল না। শরণার্থীদের স্বাধীন দেশে ফেরা নিশ্চিত করার সময়ই খবর পাই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন এবং দেশের পথে রওনা দিয়েছেন। আমিও তাই ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরে আসি। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের সময় মেঘালয়ের বালাটসহ স্মৃতিবিজড়িত এলাকাগুলোতে যাওয়ার ইচ্ছা আমার মনের মধ্যে অনেক দিন ধরেই ছিল। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সেই সুযোগ আসে। সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে বিশ্বের ১২১টি দেশের জোট ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্সের (আইএসএ) সম্মেলনে যোগ দিতে ওই সময় আমি ভারত সফর করি। সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এলাকাগুলো পরিদর্শন করি।
ওই সফর ছিল আমার কাছে বড় আবেগময়। বিশেষত বালাট অঞ্চলে গিয়ে যুদ্ধদিনের নানা স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠছিল। তখন যে দুঃসহ সময় কাটিয়েছি, তা এখন চিন্তাও করা যায় না। প্রতিদিন মৃত্যু ও হতাহতের সংবাদ পেতাম আর স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব অপেক্ষা করতাম। কবে স্বাধীনতা আসবে আর আমরা স্বদেশে ফিরে যেতে পারব।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কেবল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেনি; সে দেশের জনসাধারণও বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছে। মেঘালয় ও বালাটের মানুষও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। মার্চের ওই সফরে গিয়ে আমি তাদের ত্যাগের কথা স্বীকার করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছি।
একটা বিষয় বেদনাদায়ক ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বালাট এলাকায় নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তাদের অনেকে আর বেঁচে নেই। আরও আগে যেতে পারলে হয়তো দেখা হতো। দুঃসময়ের সব বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলেও যে দু-একজনের দেখা পেয়েছি, সেটাও কম ছিল না। মারাক ও রজত নামের দুই আদিবাসীর সঙ্গে স্মৃতিচারণা করেছি। বালাটের যে বাড়িতে আমি পরিবার নিয়ে ছিলাম, সেই বাড়িতেও গিয়েছি। সেখানকার একটি চায়ের দোকান ছিল আমার প্রিয় জায়গা। সেখানেও গেছি। এমন অনেক বীরত্ব ও বেদনার গল্প দিয়ে ভরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা।
এটা স্বীকার করতে হবে, আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা একাত্তরে পেলেও অর্থনৈতিক মুক্তি আসতে সময় লেগেছে। কারণ, পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ পটপরিবর্তনের পর দেশ পেছনের দিকে যেতে থাকে। আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধু সব সময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে এসেছে নতুন যুগ। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারিতেও বাংলাদেশকে ‘দাবায়ে রাখা’ যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করছে।
এ বছর স্বাধীনতা দিবস আমাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা একই সঙ্গে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। আমরা যারা স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশ নিয়েছি, তাদের জন্য এর চেয়ে বড় মাহেন্দ্রক্ষণ আর আসতে পারে না। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে। যে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমি বিশ্বাস করি তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সামনে রেখে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ গঠনেও সফল হবে। এবারের স্বাধীনতা দিবসে সেটাই হোক সবার অঙ্গীকার।
মোঃ আবদুল হামিদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি