- সিন্ডিকেটের কবল থেকে উদ্ধার করা হবে সাধারণ ভোক্তাদের
- ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ
- খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে সহায়ক শুল্ক ও ভ্যাট নীতি
- অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা
নিত্যপণ্যের বাজারে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে আসছে বেশকিছু নতুন কৌশল। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির এই হার গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করা হবে সাধারণ ভোক্তাদের। বাজেটে বেশকিছু পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্য আমদানিতে সহায়ক শুল্ককর ও ভ্যাটনীতি অবলম্বন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম বেগবান করার মতো কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন কৌশলে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে চাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, মুরগি ও চিনির দাম। এছাড়াও আশা করা হচ্ছে, আগামী অর্থবছরে দেশ-বিদেশে খাদ্য উৎপাদন ভাল হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে কম থাকবে। এর সুফল দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে এসে পড়বে। মানুষ ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী কিনতে পারবেন। স্বস্তি ফিরবে বাজারে। জানা গেছে, আগামী ৩ জুন মহান সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। এ যাবতকালের মধ্যে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার সর্ববৃহৎ এই বাজেটে দ্রব্যমূল্য কমানোর বিষয়টিকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে বলেন, ন্যায্যমূল্যে দ্রব্যমূল্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার সব সময় আন্তরিক। আর এ কারণে পেঁয়াজ, চাল ও ভোজ্যতেলসহ আরও নানা রকম পণ্যে ইতোমধ্যে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়েছে। আগামীতে বাজারে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক থাকবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে একটি চাপ তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যসহ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখা গেলে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
জানা গেছে, চলতি বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কম থাকলেও গত একবছর অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে ভোক্তাদের বেশি দাম দিয়ে খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। এ কারণে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করে তা ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করে বাজার সামাল দিতে হয়েছে। এছাড়া বেড়েছে চাল ও ভোজ্যতেলের। উৎপাদন কম হওয়ায় সবজিও সঠিক দামে পাওয়া যায়নি।
খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা গেলে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের মতো নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে বলে মনে করছে সরকার। এলক্ষ্যে নতুন বাজেটে খাদ্যপণ্য আমদানিতে সহায়ক শুল্ককর ও ভ্যাটনীতি অবলম্বন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি প্রদান এবং বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির কার্যক্রম বেগবান করা হবে। জানা গেছে, করোনার কারণে গত এক বছরে সীমিত আয়ের মানুষের আয় উপার্জন কমে গেছে। অন্যদিকে চাল আটা, চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। পেঁয়াজের দাম বাড়লেও দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির কারণে এখন বাজারে এই পণ্যটির দাম কমেছে। আগামী ৩ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
বাজারে সারাবছর যাতে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকে সেই কৌশল নেয়া হচ্ছে বাজেটে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে জানান, সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চাল, পেঁয়াজ ও চিনির মতো পণ্যের দাম যাতে আর না বাড়ে সেজন্য আমদানি সহায়ক ভ্যাট ও শুল্ককর নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষের উপার্জন কমে গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সবমিলিয়ে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাজারে চাল ও গমের দাম সরবরাহ বাড়াতে আমদানি কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী খাতে আমদানি হচ্ছে চাল। শুধু সরকারী পর্যায়ে ২০ লাখ টন চালের মজুদ বাড়ানো হবে। এছাড়া আটার দাম নিয়ন্ত্রণে গম আমদানি করছে সরকার। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে আগামী বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। বিশেষ করে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি, সার ও বীজ আমদানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে। উল্লেখ্য গত ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার, গড় মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার কৌশল গ্রহণ করে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় ওই সময়। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। এটাকে সরকারের অন্যতম অর্থনৈতিক সাফল্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৯ অর্থবছরে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সঙ্গে সঙ্গে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অগ্রগতির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সফল হয়েছে বর্তমান সরকার। করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও বেকার মানুষ বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেকে হেরে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকারকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেটে এখন সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হলো ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানো। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে নগদ সহায়তাসহ যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এগুলো আগামী বছরও অব্যাহত রাখতে হবে। বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানোর আরেকটি উপায় হলো বেসরকারী খাতকে আয়ে ফিরিয়ে আনা। ভাক্তার অধিকার ও সচেতনতা নিয়ে কাজ করেন এমন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, একদিকে মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানো, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বর্তমান ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ধরে রাখা এ দুটি বিষয়কে সামনে রেখে তৈরি হওয়া উচিত আগামী বাজেট। এ জন্য কর ও শুল্কনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি, বেসরকারী খাতকে আয়ে ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো ও নিচের দিকে কর হারের স্তর বাড়ানো ইত্যাদি পদক্ষেপ বাজেটে থাকতে হবে।
সহায়ক আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট নীতি ॥
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে সহায়ক আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট নীতি আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের এ প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। যেমন এক কেজি চিনি আমদানিতে ২৪ টাকা শুল্ক ও কর দিতে হয়। সে জন্য ভোজ্যতেল, ডাল, চিনির মতো নিত্যপণ্য আমদানি শুল্কমুক্ত করা দরকার। এমন পদক্ষেপে যেটুকু রাজস্ব কমবে, তা বিলাসপণ্যের ওপর শুল্ক ও কর বৃদ্ধি করে পূরণ করা সম্ভব। চলতি বাজেটে চিনি ও রসুন আমদানি পর্যায়ে অগ্রীম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। একই সুবিধা দেয়া হয়েছে পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য আমদানিতে। তবে বাজারে চড়া মুরগির দাম। চাল, আটা, আলু, পেঁয়াজ ও রসুনের স্থানীয় সরবরাহকারীর ৫ শতাংশ উৎসে আয়কর কমিয়ে করা হয়েছে ২ শতাংশ। এর ফলে বাড়বে এসব পণ্যের ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা। দাম কম হওয়ার কারণে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্কারোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আবার দাম বেশি হওয়ার কারণে আর চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া রমজান মাসে ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে ৪ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহর করা হয়েছে।