নিজস্ব প্রতিবেদক:
আর্থিক হিসাব অর্থাৎ আয়-ব্যয় এবং স্থায়ী সম্পদের মিথ্যা বা সন্দেহজনক তথ্য প্রদানের জন্য গত তিন মাসে এক ডজনেরও বেশি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংস্থার শীর্ষ পদে বড় রদবদলের আগে যেখানে আইপিও আবেদন ছিল ৩২টি, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ১২টিতে। অস্বচ্ছ আইপিও আবেদন করে কেউ আর অনুমোদন পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সুশাসন ফিরছে শেয়ারবাজারে। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আবার আশায় বুক বাঁধছেন।
কমিশনের চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে আর কোনো কোম্পানি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির অনুমতি পাবে না। বিএসইসির কর্মকর্তারা জানান, বহু কোম্পানির মূল মালিকরা (উদ্যোক্তা ও পরিচালক) শেয়ার নিয়ে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারে আসতে চাইছেন। এজন্য মার্চেন্ট ব্যাংক, অডিটর, ব্যাংকারসহ একটা বিশাল চক্র গড়ে উঠেছে। এমনকি অনেক প্রভাবশালীও তাদের পক্ষে কাজ করছেন। বর্তমান কমিশন গত মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে। কর্মকর্তারা আরও জানান, আইপিওতে আসার আগেই তাদের অনেকেই প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করে বড় অঙ্কের ব্যবসা করেছেন। বিশেষত প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির টাকা আত্মসাৎ করেন এবং কোম্পানির সম্পদ বাড়িয়ে দেখিয়ে ওই শেয়ার বিক্রিকে হালাল করার চেষ্টা করেন। কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা ১০ টাকার শেয়ার ২০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করে কোম্পানির হিসাবে ১০ টাকায় বিক্রি দেখিয়েছেন। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর শেয়ারদর বাড়িয়ে ওই সব শেয়ার বহুগুণ মূল্যে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে যান তারা। এখন ওই রকম বেশ কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তাদের হদিস নেই। কোম্পানি বন্ধ এবং শেয়ারহোল্ডাররা হাজার হাজার কোটি টাকার শেয়ার নিয়ে ঘুরছেন। এমন অনিয়ম হওয়ার কারণেই পুরো শেয়ারবাজার রুগ্ণ হয়ে পড়েছিল। সর্বস্বান্ত হয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। বর্তমান কমিশন চায়, এমন আরেকটি ঘটনারও যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
কর্মকর্তারা জানান, এ কারণে মাত্র তিন মাসে ১৩ কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হতে পারে আরও বেশ কিছু আইপিও আবেদন। বর্তমানে আরও ১২ কোম্পানির আইপিও আবেদন কমিশনের বিবেচনায় রয়েছে।
গত তিন মাসে যেসব কোম্পানির আবেদন বাতিল হয়েছে, সেগুলো হলো- ইনফিনিটি টেকনোলজি ইন্টারন্যাশনাল, বি ব্রাদার্স গার্মেন্টস, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং, আল-ফারুক ব্যাগস, ডেল্টা হসপিটাল, গার্ডিয়ানা ওয়্যারস, বিডি পেইন্টস, বোনিতো এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বেকা গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল, এসএফ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, হজ্জ ফাইন্যান্স, থ্রি এঙ্গেল মেরিনার্স এবং নিয়ালকো অ্যালোস।
তবে আইপিও আবেদন বাতিলের বিপরীতে একই সময়ে বিএসইসি ছয় কোম্পানির আইপিও অনুমোদন করেছে। এগুলো হলো- ওয়ালটন হাইটেক, মীর আখতার হোসেইন, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, ডোমিনোজ স্টিল এবং এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স। আরও কয়েকটি কোম্পানি আইপিও অনুমোদন প্রদানে কমিশনের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। এর মধ্যে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি অন্যতম।
আইপিও আবেদন বাতিলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম সমকালকে বলেন, বেশিরভাগ কোম্পানির আইপিও আবেদন যাচাইয়ের পর দেখা যাচ্ছে কোম্পানিগুলো আয়-ব্যয় ও সম্পদের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। কারও আয়ের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সের, কারও ব্যাংক হিসাবের তথ্যে মিল নেই। কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই রাতারাতি আয় বেড়েছে। এ ধরনের কোম্পানিকে শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া হবে না। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কেউ আর ঠকাতে পারবেন না। চেয়ারম্যান আরও বলেন, আইপিওতে আসতে চাইলে কোম্পানির আর্থিক হিসাব অবশ্যই সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। তিনি বলেন, যেসব কোম্পানির দীর্ঘদিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা রয়েছে, যারা ব্যবসা করে মুনাফা করতে পারবে এবং শেয়ারহোল্ডারদের লাভের ভাগ দিতে সক্ষম হবে, কেবল সেসব কোম্পানিই আইপিও প্রক্রিয়ায় মূলধন সংগ্রহের অনুমতি পাবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত তথ্যসংবলিত কোনো আইপিও প্রসপেক্টাস অনুমোদনের জন্য কমিশনে জমা দিতে পারে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু যেসব কোম্পানির আইপিও বাতিল হয়েছে, সেগুলোর সকল তথ্য যাচাই-বাছাই করে সংশ্নিষ্ট ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানগুলো (মার্চেন্ট ব্যাংক) সকল তথ্য সঠিক মর্মে সার্টিফিকেট দিয়েছিল। এমনকি অডিটর প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিক প্রতিবেদনের অসংগতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে করা আইপিও আবেদন বাতিল করা হলেও একটি বাদে সংশ্নিষ্ট কোম্পানি, ইস্যু ম্যানেজার (মার্চেন্ট ব্যাংক) এবং অডিটর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিএসইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি এখন যেসব কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল হয়েছে, সেগুলো ভুল সংশোধন করে পুনরায় আবেদন করলে তা আরও কঠোরভাবে যাচাই করা হবে। এক্ষেত্রে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা হলে অবশ্যই শাস্তির মুখে পড়তে হবে তাদের।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে কমিশনকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। মন্দ আইপিওগুলো মার্চেন্ট ব্যাংক পর্যায়েই বাতিল হতো। কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক একের পর এক মিথ্যা হিসাবসংবলিত আইপিও আবেদন নিয়ে এলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক যদি জেনেবুঝে মিথ্যা আর্থিক প্রতিবেদন-সংবলিত প্রসপেক্টাস জমা দেয়, তবে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রতি দুই বছরে প্রতিটি মার্চেন্ট ব্যাংককে বাধ্যতামূলক আইপিও আবেদন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক জেনেবুঝেই মন্দ আইপিও নিয়ে আসছে দাবি করে ছায়েদুর রহমান বলেন, কমিশনের উচিত এ বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া। তাহলে এ প্রবণতা কমবে।
আইপিও অনিয়মে জড়িত থাকার অপরাধে বিএমবিএ সংশ্নিষ্ট মার্চেন্ট ব্যাংকের সদস্য পদ বাতিল করতে পারে কি-না, এমন প্রশ্নে ছায়েদুর রহমান বলেন, ইস্যু ম্যানেজার হতে বিএমবিএর সদস্যপদ থাকা বাধ্যতামূলক নয়। তবে বিএসইসি যদি এ বিষয়ে আইন করে দেয়, তখন বিএমবিএ অনৈতিক বা অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য সদস্য মার্চেন্ট ব্যাংকের সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অবশ্য শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ মনে করেন, যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের সদস্য পদ বাতিল করা উচিত। এটা করলে ভাবমূর্তি বাড়বে এবং যারা অন্যায় করবে, তারা এমন কাজে নিরুৎসাহিত হবে।
সাম্প্রতিক আইপিও বাতিলের বিষয়ে আবু আহমেদ বলেন, কমিশন সঠিক কাজটিই করেছে। মন্দ আইপিও বাতিল করে কমিশন এমন বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে সবার ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবে শুধু আইপিও আবেদন বাতিল নয়, কমিশনের উচিত, যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও আবেদন করছে, তাদের সকলের বিরুদ্ধে মামলা করা। একটি-দুটি ক্ষেত্রে বড় শাস্তি হলে এই অপরাধ কমবে। অডিটরের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা একটা সংঘবদ্ধ চক্র। এ চক্রকে যেকোনো মূল্যে রুখতে হবে।