নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা ভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় এখনই অনেক দেশ আবার জনসাধারণের অবাধ চলাচলে কড়াকড়ি করেছে। কোনো কোনো দেশ নতুন করে লকডাউন আরোপের কথাও ভাবছে। বাংলাদেশেও এরই মধ্যে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আসছে শীতে যার তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার আবারও সমন্বিত রোড ম্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চলছে নানা প্রস্তুতি। এরই মধ্যে করণীয় নির্ধারণে সরকারের কাছে একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে জনসাধারণকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মানতে সরকারকে কঠোর হতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিতে হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা, সচেতনতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন সুবিধা বাড়ানোর জন্যও প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার রোডম্যাপ প্রণয়নে গত ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। সভায় স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং পুলিশের আইজি উপস্থিত ছিলেন। সে সময় উপস্থিত অধিকাংশ কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর আইন প্রয়োগের তাগিদ দেন। এ ছাড়া সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সবাই যাতে মাস্ক পরে, শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে চলে এ জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারাভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। মাঠ প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী কীভাবে অভিযান পরিচালনা করবে, সে বিষয়েও একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হবে।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে সরকারি-বেসরকারি সব দপ্তরে এ পলিসি কঠোর মেনে চলার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। এমনকি মাস্ক ছাড়া রাস্তায় বের হলে জরিমানা গুনতে হবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। কেউ কোনো দপ্তরে কোনো কাজের জন্য গেলে অবশ্যই তাকে মাস্ক পরতে হবে। দোকান, শপিংমল, হাট-বাজার সবখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আরও আগেই। তবে এটির বাস্তবায়ন খুবই ঢিলেঢালা। এ জন্য পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
একইভাবে নৌ-বিমান ও স্থলবন্দরে কঠোর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে করোনা নেগেটিভ সনদ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে দেশে ঢুকতে না দিতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে আসার পরও যদি শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে কিংবা অন্য কোনো ধরনের লক্ষণ থাকে, তা হলে তাকে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। করোনা নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টিন মেনে চলতে হবে। বহির্গমনের ক্ষেত্রেও করোনা নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতালে যাতে কোভিড-ননকোভিড রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা পান সেটিও নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সারাদেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকে যথাযথ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ভারতে বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। সে দেশ থেকে আসা সম্ভাব্য রোগীদের বা যাত্রীদের বিমান, স্থল বা নৌবন্দরেই কোভিড পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নেগেটিভ না হয়ে যেন কেউ দেশে ঢুকতে না পারে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বলেন, সতর্কতামূলক ব্যবস্থ্য হিসেবে মাস্ক পরিধান, হাত জীবাণুমুক্তকরণ ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুল রউফ তালুকদার বলেছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি হতে সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেই অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, সব ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রয়োজনে গণপরিবহন চলাচল স্থগিত করতে হবে এবং শপিংমল ও বাজারগুলো খোলা রাখার ব্যাপারে আবার নতুন করে সময়সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মাদ খুরশিদ আলম বলেন, মানুষ ধীরে ধীরে হার্ড ইমিউনিটির দিকে যাচ্ছে। তবে সবাইকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান, টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো এবং সব হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ, টেলি ডাক্তারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সহায়তা প্রদান এবং হাসপাতালে সেবা এবং ভর্তির সুযোগ রাখতে বলেন।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা বৈঠকে জানান, বাংলাদেশে কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সুরক্ষাব্যবস্থা প্রতিপালনে জনগণের অনীহা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণ এবং ভ্রমণে সীমাবদ্ধতা উঠিয়ে নেওয়া প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য তিনি সচেতনতামূলক কর্মসূচি, অধিক পরিমাণ টেস্ট, বিপজ্জনক অঞ্চল চিহ্নিতকরণ এবং হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সূত্র জানায়, ওই সভা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে বলা হয়েছে দেশের প্রতিটি মানুষ যেন মাস্ক পরে ঘরের বাইরে বের হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজকর্ম করতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের করণীয় বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোজাহেরুল হক আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে করোনার টেস্ট অপ্রতুল, এটি বাড়াতে হবে। যেগুলো হচ্ছে তা অনেকে বিদেশ যাওয়ার জন্য। এর মধ্যেও ১০-১২ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে। এটি ৫ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। এ জন্য প্রথম বা দ্বিতীয় ওয়েভের চিন্তা করে লাভ নেই। সবাইকে মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। যারা আইন মানবে না তাদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।