৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান মিলেছে, আছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০ জাতের কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় সম্ভব, মন্ত্রণালয়গুলোর জরুরি সমন্বয় দরকার
নিউজ ডেস্ক:
সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনায় বাংলাদেশ। দেশের স্থলভাগের প্রায় সমপরিমাণ সমুদ্রসীমায় এখন মূল্যবান সম্পদের ভান্ডার। ভারত ও মিয়ানমার থেকে অর্জিত সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক রয়েছে। ইজারা দিয়ে এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া নীল জলরাশির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিচিত্র সামুদ্রিক সম্পদ। তেল, গ্যাস, মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, শামুক, ঝিনুক, মাছ, অক্টোপাস, হাঙর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ রয়েছে নীল সাগরে। সেখানে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ছাড়াও ২০ জাতের কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ৩৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুকের সন্ধান পাওয়া গেছে। টুনার মতো দামি ও সুস্বাদু মাছ রয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা প্রচুর।
২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ। এর পরই কখনো ধীরে কখনো দ্রুতগতিতে সুনীল অর্থনীতি বা ‘ব্লু ইকোনমি’র চূড়ান্ত অর্জনের জন্য কাজ করতে থাকে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ গঠন করে সরকার। সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট করেছে সরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রথম বিভাগীয় সভাপতি ও সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জন করেছে। এর একটি হলো প্রাণিজ আরেকটি অপ্রাণিজ। প্রাণিজের মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যদি। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। আরও রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালু। যেমন জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
সূত্রমতে, স্থলভাগের আয়তন যেখানে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার সেখানে সমুদ্রে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের মালিকও এখন বাংলাদেশ। সমুদ্র অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এ সমুদ্র অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত কাজ করা উচিত। কেউ কেউ এ সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে ‘সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয়’ নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করারও পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ‘আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে কাজ করার পরামর্শও তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে। সমুদ্রের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তা টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অপার সম্ভাবনাময় এ খাতকে কাজে লাগানো জরুরি। সমুদ্রের তলদেশে কী ধরনের সম্পদ রয়েছে, সেগুলো আহরণ করতে হলে কোন ধরনের প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ জনবল প্রয়োজন তা পরিকল্পনামাফিক নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জানা যায়, তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ১৩ জায়গায় সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালু অর্থাৎ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম রয়েছে যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গানেট, সেলিমেনাইট, জিরকন, রুনটাইল ও ম্যাগনেটাইট। এ ছাড়া সমুদ্রের গভীরে জমে আছে কাদা যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। বঙ্গোপসাগরের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। এ ছাড়া প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ন্যূনতম ১.২৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূলে। সেখানে মোট ১৭ প্রকার খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাশনেটাইট, লিউকোক্সিন, কিয়ানাইট, মোনাজাইট দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষমতা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে সুনীল অর্থনীতি কাজে লাগাতে পারলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তবে দেশে এখন পর্যন্ত সমন্বিত নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। গত আট বছরে গভীর-অগভীর সমুদ্রসম্পদ অনাবিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমার, ভারত সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ দেশে সীমিত পরিসরে তেল-গ্যাস আহরণ শুরু হয়েছে যা বঙ্গোপসাগরে অফুরন্ত তেল-গ্যাস ভান্ডারের তুলনায় খুবই স্বল্প। পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে। এতেই ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রসৈকতের বালুতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সঙ্গে দুটি অগভীর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসের সঙ্গে গভীর ব্লক ১১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সঙ্গে গভীর ব্লক ১২-এ চুক্তি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্রসম্পদ আহরণে কার্যকর জরিপ-গবেষণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সমুদ্রবেষ্টিত হওয়ায় সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। নৌপথ ও সমুদ্র অর্থনীতি আমাদের অন্যতম শক্তিশালী উৎস হিসেবে অচিরেই আত্মপ্রকাশ করবে। সুনীল অর্থনীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে আমাদের কিছু কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে একটি সবল নীতিকাঠামো গঠন করা প্রয়োজন। এ জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’
সুনীল অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান : সুনীল অর্থনীতি বাস্তবায়নে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নয়টি গবেষণা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে সমুদ্রোপকূলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ, শিলা কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন ও ওয়েস্টার চাষ, হরিণা ও চাকা চিংড়ির চাষ, খাঁচায় ভেটকি ও মুলেটের চাষ, গ্রিন মাসলের চাষ ইত্যাদি অন্যতম।
জানা যায়, বিএফআরআই এসব উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ওয়েস্টার ও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন ভেটকি ও মুলেটের প্রজনন, চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো হ্যাচারিতে শিলা কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে এ পর্যন্ত ১৩৮ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ প্রজাতির শৈবাল বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানিযোগ্য ও লাভজনক। ইতিমধ্যে তিন প্রজাতির শৈবাল চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব শৈবাল উন্নত খাদ্যমান ও ঔষধি গুণসম্পন্ন এবং প্রাকৃতিক মিনারেলসমৃদ্ধ। এতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। খাদ্য ও ওষুধ শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে শৈবাল। বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদন বাড়াতে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বাজারজাত, গবেষণা ও প্রচারণায় গুরুত্ব দিয়েছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্লু ইকোনমি’র সাফল্যে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে আমরা বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে নৌযান কেনা, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মৎস্য ও সমুদ্র সম্পদ আহরণে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজনের প্রস্তুতি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞ শুরু হবে।’
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে চার বছর ধরে আমরা গবেষণা করছি। আমরা দেশের সব উপকূলীয় এলাকায় শৈবাল নিয়ে কাজ করব। ইতিমধ্যে পটুয়াখালীতে একটি গবেষণা ল্যাব বসানো হয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও আহরণে দক্ষ করে তুলতে কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় ৩২০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’