নিউজ ডেস্ক :
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ভিত্তি করে মোটা টাকা কামিয়ে নিতে যারা সিন্ডিকেট করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। শিগগিরই এ সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি করবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া এ কাণ্ডে মালয়েশিয়াতে তদন্তে যাচ্ছে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন। আজ রবিবার হাইকমিশনারের সে দেশে যাওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে ভিসা পেয়েও যারা মালয়েশিয়ায় যেতে পারছেন না, তাদের দ্রুত পাঠানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শামীম আহসান। গত শুক্রবার রাতে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য ফের মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। দেশটির সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, ৩১ মের পর বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের কর্মী সে দেশে ঢুকতে পারবে না। এ কারণে শেষদিন অর্থাৎ গত শুক্রবার মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে উপচেপড়া ভিড় ছিল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কিন্তু ভিসা পেয়েও দেশটিতে যেতে পারেননি ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি। তারা এখন চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে যে বা যারা এ সংকট সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। গতকাল এ হুশিয়ারি দিয়ে তিনি তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানান। এদিন দুপুরে সিলেট নগরের ঐতিহ্যবাহী আলিমা মাদ্রাসা পরিদর্শনের পর প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি হবে এবং সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বায়রার ওপর দোষ চাপিয়ে শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, মালয়েশিয়ায় পাঁচ লাখের উপরে কর্মী প্রেরণের জন্য দেশটির সরকার কোটা দিয়েছিল। সেই কোটা পূরণে কাজ করেছিল বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার সাথে কথা বলে কাদের ভিসা হয়েছে আর কাদের ভিসা হয়নি সেই তথ্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বায়রা সেই তালিকা দিতে পারেনি। ফলে ফ্লাইটের সমস্যা হয়েছে।
সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরবর্তী সময়ে কর্মী পাঠানোর জন্য ২২টি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারকে সময় বাড়ানোর জন্যও চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। তবে এখনো সেই চিঠির উত্তর আসেনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বায়রার সঙ্গে বারবার বসেছি, আলোচনা করেছি। গত ১৫ মে তাদের সঙ্গে সর্বশেষ সভা করে বলেছিলাম চূড়ান্ত তালিকা করার জন্য। কতজন বাকি রয়েছে, কীভাবে যাবে, কতজনের ভিসা বাকিÑ এসবের তালিকা জমা দিতে বলেছি। কিন্তু তারা তালিকা দিতে পারেনি।
একেবারে শেষ মুহূর্তে বায়রার পক্ষ থেকে আমাদের মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে- আমাদের কর্মীরা রেডি কিন্তু আমরা ফ্লাইট পাচ্ছি না। এরপর বিমানমন্ত্রী, বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করি, কথা বলি। যে কারণে বিশেষ ২২টি ফ্লাইট দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও সংকটের শেষ হয়নি।
দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে উল্লেখ করে শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের ব্যাপারে আমরা তদন্ত কমিটি করব। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মালয়েশিয়া যেতে অনেকে জায়গা-জমি বিক্রি করে যেতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য কি করা হবেÑ এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে ৭৮ হাজার ৯০০ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল। বেসরকারিভাবে কে কত টাকা দিয়েছেন, সেটা আমাদের জানা নেই। এর পরও যারা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন, তাদের বিষয়ে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। তারা দরখাস্ত করলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এদিকে যেসব বাংলাদেশি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন, তাদের নিয়োগকর্তারা রিসিভ করতে দেরি হওয়ায় প্রায় ২০ হাজার কর্মী আটকা পড়েছিলেন। গতকাল শনিবার সকালে কর্মীরা নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দেন, বিমানবন্দরের অবস্থা স্বাভাবিক হয়।
মালয়েশিয়া যাচ্ছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার
মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক আজ রবিবার সে দেশে যাচ্ছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকার নিশ্চিত করতে যথেষ্ট তৎপর না-থাকার অভিযোগ রয়েছে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে।
নতুন করে বিদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করার পর মালয়েশিয়া সফরে যাচ্ছেন ভলকার তুর্ক। কুয়ালালামপুর ও পুত্রজায়ায় তিনি দেশটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং মালয়েশিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গেও বৈঠকের কথা রয়েছে তার। তিনি আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আইনজীবী, অভিবাসী ও শরণার্থী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন।
এর আগে গত ২৬ মে জাতিসংঘের চার স্বাধীন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে পাঠানো একটি চিঠি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক অমানবিক পরিস্থিতিতে রয়েছেন। বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অপরাধী চক্রগুলো সক্রিয়। এসব চক্র প্রতারণার মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ভুয়া কোম্পানিতে শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়। এর ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ঋণের চক্রে আটকা পড়েন।
প্রবাসী শ্রমিকদের শোষণের সঙ্গে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, রিক্রুটিং এজেন্সি ও সরকারি কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে চিঠিতে আরও বলা হয়, অনেক প্রবাসী শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পৌঁছে প্রতিশ্রুত চাকরি পান না। এতে তারা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও সেখানে থাকতে বাধ্য হন। ফলাফল হিসেবে শ্রমিকদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করার ঘটনা ঘটে।