নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর তেজগাঁও বস্তিতে রহিমা খাতুন বসবাস করেন অনেক বছর ধরে। ১৫ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই বিয়ে করে আলদা সংসার নিয়ে থাকেন।
ছোট ছেলেকে নিয়ে বস্তির মধ্যে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন ৬৫ বছরের রহিমা খাতুন। অস্থায়ী গৃহপরিচারিকা হিসেবে একাধিক বাসায় কাজ করে জীবিকা চালাতে হয়। ‘যোগ্য’ হওয়ার পরও বয়স্ক ভাতা পান না তিনি।
রহিমা খাতুনের মতো সারা দেশে এরকম অসংখ্য দুস্থ বয়স্ক বিধবা আছেন, যারা ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা থাকার পরও সরকারের আর্থিক সুধিবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যোগ্যদের ৪৬ শতাংশই এখনও সামাজিক সুরক্ষার আওতার বাইরে। তবে প্রতি বছরই সামাজিক সুরক্ষা জাল প্রসারিত করছে সরকার। এবারের বাজেটেও বাড়বে সেটা।
মহামারির মধ্যেও আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
এই বরাদ্দ চলতি অর্থবছরে বাজেটের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা।
বয়স্ক, বিধবাসহ বর্তমানে আট ধরনের ভাতা আছে, যা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর বাইরে মহিলা ও শিশু, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়ের আলাদা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
এখন ৮৮ লাখ দরিদ্র লোক বয়স্ক, বিধবাসহ বিভিন্ন ধরনের ভাতা পাচ্ছেন। মোবাইলের মাধ্যমে সরকার এখন সুবিধাভোগীদের কাছে সরাসরি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। ফলে এ খাতে দুর্নীতি কমবে বলে আশা করছে সরকার।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে বলে সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
এদের সুরক্ষা দিতে আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদেরা।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম মনে করেন, ‘যোগ্যদের অনেকেই সামাজিক সুরক্ষার আওতার বাইরে এবং এতে ব্যাপক অপচয় হয়। তবে এ খাতে অনিয়ম কমিয়ে আনতে ডিজিটালাইজেশনসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনা মোকাবিলায় জরুরি তহবিল বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়াতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
তার মতে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের অর্থ যাতে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা পান, তা নিশ্চিত করা এবং কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে নানা ধরনের অনিয়ম দূর করা জরুরি। তা না হলে এর সুফল সুবিধাভোগীরা পাবে না।
অনেকেই মনে করেন, দারিদ্র্য বেশি গ্রামে। তাই সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজন সেখানে বেশি। ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, সামাজিক সুরক্ষায় গ্রাম-শহরের ভেদাভেদ করা উচিত নয়।
‘সচ্ছলরা’ বেশি সুবিধাভোগী
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, শুধু হতদরিদ্ররাই সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাবেন। কিন্তু সমাজের বহু সচ্ছল পরিবারও এ সুবিধা নিচ্ছেন।
পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদসহ বেশ কিছু খাতে সামাজিক সুরক্ষার অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এখানে সমাজের বহু সচ্ছল পরিবারের বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে প্রকৃত গরিব মানুষ সামাজিক সুরক্ষার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
পরিসংখ্যানে বলে, বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ মানুষ বিত্তশালী। কিন্তু এদের বড় একটি অংশ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় সুবিধা গ্রহণ করছেন।
২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিতরণ করা সুবিধার ৭৫ শতাংশই পেয়েছেন সচ্ছলরা। তার মানে, যারা পাওয়ার যোগ্য তাদের বেশির ভাগই পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রকৃত দরিদ্ররা এই কর্মসূচির মধ্যে ঢুকতে পারছেন না।
ফলে এ খাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক নিরাপত্তার নীতিমালা পর্যালোচনা করে তা সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পেনশনের টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে
বেশ আগে থেকেই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনের টাকা বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো হয়।
বিদায়ী অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় যে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে পেনশন বাবদ আছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-ভর্তুকি বাবদ ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
এই দুই খাতে বরাদ্দ, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মোট বরাদ্দের ৩৫ শতাংশ। এ দুটি খাত বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় দাঁড়ায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
এ ব্যয়েরও সিংহভাগ অর্থ প্রকৃতপক্ষে যাদের পাওয়ার কথা, তারা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, পেনশনের টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো হয় কেন?
সাবেক অর্থসচিব বর্তমানে মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) মুহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, পেনশনের বিষয়টি সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা উচিত কি অনুচিত, তা আলোচনার দাবি রাখে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, পেনশনের টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে আসার কথা নয়। এটা দরিদ্রদের সুরক্ষা দেয় না। এটা আলাদা খাতে দেখানো উচিত।
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা অবসরের পর পেনশন পান। আবার নিম্ন স্তরের পিয়নও পেনশন পান। এগুলোর সব সামাজিক সুরক্ষার আওতায় পড়ে না।
ধরা যাক, একজন সরকারি কর্মচারী ২০ বিঘা জমির মালিক। ওই ব্যক্তিকে কেন সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে? সামাজিক সুরক্ষা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা পর্যালোচনা করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পেনশনের টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেখানো উচিত নয়। কারণ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীরা হতদরিদ্র নন।’
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা শুধু তাদেরকেই দিতে হবে, যারা হতদরিদ্র, কোনো আয়-রোজগার নেই। এ জন্য যে নীতিমালা আছে, তা পর্যালোচনার পরামর্শ দেন তিনি।
বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ১৩২টি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু নগদ অর্থও দেয়া হচ্ছে।
তবে বেশির ভাগই কর্মসূচিভিত্তিক। বয়স্ক, বিধবা ভাতাসহ সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন আটটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে মাতৃত্বকালীনসহ আরও কয়েকটি ভাতা। মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানী ভাতা। ভিজিএফ, ভিজিডি, টিআর, কাবিখাসহ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে ১১টি কর্মসূচি।
এর বাইরে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।