নিউজ ডেস্ক:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশ থেকে গুজব ও অপপ্রচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আসছে কঠোরতা। ইউটিউব, ফেসবুকের অফিস ঢাকায় আনাসহ ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি বন্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। গুজব ও অপপ্রচার রোধে আনা হবে আইনের সংশোধনী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে একটি গোষ্ঠী দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে সাইবার যুদ্ধ শুরু করেছে। বেশির ভাগ করা হচ্ছে বিদেশে বসে। অন্যদিকে আরেকটি গোষ্ঠী বাংলাদেশে তা সম্প্রচারে বা ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করছে। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে করা অনুরোধও রক্ষা করছে না ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম। এ কারণে ভারত সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে কঠোরতার মধ্য দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নজর দিচ্ছে, বাংলাদেশও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের আইন-কানুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মতৎপরতা বন্ধে কঠোর আইনের পাশাপাশি ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোর অফিস ঢাকায় স্থাপন জরুরি। তাদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটর করতে না পারলে সরকার ও সমাজে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আর এখানে তাদের অফিস স্থাপন না হলে অপরাধী শনাক্ত ও তাদেরকে আইনের আওতায় আনাও কঠিন হবে। ইতিমধ্যে ভারত, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব-আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপকর্ম রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কঠোর আইনের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে এসব অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোর ডাটা সেন্টার বা অফিস স্থাপনে বাধ্য করেছে।
এক দশক আগেও বাংলাদেশে ফেসবুক বা ইউটিউব খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। বর্তমানে খুব কম মানুষই আছে যার ফেসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট নেই। কারও আবার আসল-নকল মিলিয়ে তিন-চারটি অ্যাকাউন্টও রয়েছে। ফলে পণ্যের প্রচারণা থেকে শুরু করে গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা সৃষ্টি বা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা- সবকিছুতেই ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক। সম্প্রতি একইভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইউটিউব। অ্যাকাউন্ট বাড়ছে টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিঙ্কডিন, টিকটক, লাইকি, ভিগো লাইভের মতো প্ল্যাটফরমগুলোয়। আর এসব মাধ্যম ব্যবহার করে নারী পাচার, মাদক বিক্রি, উগ্র মৌলবাদ, অপপ্রচারের মাধ্যমে সমাজে ও রাষ্ট্রে সহিংসতা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেওয়া, দেশ ও সরকারবিরোধী প্রচারণা, ব্যক্তি বা নারীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও আপলোড করে নারীর সম্মানহানি, অতঃপর আত্মহত্যার মতো ঘটনা, নগ্নতা থেকে শুরু করে নানা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ বেড়ে চলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক সময় অপরাধীকে শনাক্ত পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
একই সঙ্গে অধিকাংশ মানুষ এসব মাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পণ্যের প্রচারণায়ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে। পণ্যের প্রচারণা চালিয়ে এসব অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলো দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেলেও দিচ্ছে না ভ্যাট-ট্যাক্স। যেখানে দেশের গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, সেখানে ইউটিউব, ফেসবুক থেকে সরকার কিছুই পাচ্ছে না। উল্টো দেশের অর্থ চলে যাচ্ছে বিদেশে। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক মাধ্যমগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেশে তাদের অফিস স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এরই মধ্যে গুজব প্রতিরোধ, নাগরিকের ডিজিটাল নিরাপত্তা প্রদান, দেশে স্থীতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখতে কঠোর অবস্থানে যাওয়া শুরু করেছে একের পর এক দেশ। এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ওইসব দেশে ডাটা সেন্টার বা অফিস স্থাপনে বাধ্য করছে। পাশাপাশি ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করছে। ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কে এরই মধ্যে এ ধরনের আইন রয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে আইন অনুমোদন করেছে রাশিয়া। তাতে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটে কর্মকান্ড চালাতে হলে তারা রাশিয়ায় শাখা কিংবা অফিস খুলতে বাধ্য থাকবে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে জিডিপিআর (তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা) করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেখানে তারা বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের তথ্য-উপাত্ত যদি ফেসবুক-গুগল ব্যবহার করতে চায়, অবশ্যই তাদেরকে স্থানীয়ভাবে ডাটা সেন্টার স্থাপন করতে হবে। আরও নানা দেশ এ ধরনের আইন করেছে।
জানা গেছে, অন্যান্য দেশের আইন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ সরকারও এ ধরনের আইন করতে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনে বিদেশি সোশ্যাল প্ল্যাটফরমগুলোর ডাটা সেন্টার বা শাখা অফিস বাংলাদেশে স্থাপনের বাধ্যবাধকতার বিধান রাখা হচ্ছে। এটি হলে সহজেই অপপ্রচারকারীদের শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা যাবে। এ ছাড়া বিদেশে বসে যারা রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশোধিত আইনের ৩ নম্বর ধারা মতে, যদি কোনো ব্যক্তি বিদেশে বসে দেশের কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতির সাহায্যে অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটান, তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইন এমনভাবে প্রয়োগ হবে যেন অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশের ভিতরেই সংঘটিত হয়েছে।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ফেসবুক ও ইউটিউবের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে তাদের অফিস করার জন্য বারবার বলেছি। তারা শোনেনি। এখানে অফিস থাকলে বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে তাদেরকে ধরতে পারতাম। অপরাধীকে না পেলেও সংশ্লিষ্ট সামাজিক মাধ্যমটিকে পেতাম। এখন আপত্তিকর বিষয়বস্তু মনিটর করতে তারা কিছু স্থানীয় প্রতিনিধি রেখেছে, তারাও ঠিকভাবে কাজ করে না। তবে আগে আমরা অভিযোগ করলে এক শতাংশ কনটেন্টও মুছত না, এখন ২০-২৫ ভাগ কন্টেন্ট মুছে দিচ্ছে। বাকিগুলো কমিউনিটি স্টান্ডার্ডের অজুহাত দেখিয়ে রেখে দেয়। তারা ভ্যাট-ট্যাক্সও ফাঁকি দিচ্ছে। এ জন্য আমি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছিলাম। পাশাপাশি সামাজিকমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে অন্য দেশগুলোর মতো কঠোর আইন করতে বলেছি। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যরা আইন করে এসব অপরাধের জন্য জরিমানা করছে। আমাদেরকেও আইন করে তাদেরকে অফিস স্থাপনে বাধ্য করতে হবে। আমাদের কথা শুনতে বাধ্য করতে হবে। এক কথায় বললে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, আঙুল বাঁকা করতে হবে। বাংলাদেশে সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারী অনেক বেড়ে গেছে। এখান থেকে প্রচুর আয় করছে। এখন আর আমাদেরকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।
এ নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, গত ১২ বছর ধরে আমাদের যে ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। এখন আমাদের জন্য জরুরি ব্যক্তির ও রাষ্ট্রের তথ্যের নিরাপত্তা। পাশাপাশি ডিজিটালাইজেশনের অপব্যবহার করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চক্র সরকারবিরোধী অপপ্রচার ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। বিভিন্ন দেশে বসে একটি ইস্যু তুলে সেটিকে বুস্ট করে ভাইরাল করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের সুযোগ নেই। তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও সামাজিকমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে আইন আছে। এসব আইন পর্যালোচনা করে আমরা ডাটা প্রটেকশন আইনের খসড়া তৈরি করছি। যাচাই-বাছাই শেষে আইনটি নিয়মানুযায়ী অনুমোদনের জন্য দেওয়া হবে। ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিকমাধ্যমগুলো যাতে বাংলাদেশে তাদের সার্ভার ডাটা সেন্টার স্থাপন করে, আইনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা করা হবে। তখন এসব প্ল্যাটফরমে অপপ্রচারকারীদেরও বিচারের আওতায় আনা সহজ হবে। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে গত মে পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ সংখ্যা ৯৮ লাখ ১০ হাজার। একটি সংযোগের বিপরীতে চারজন ব্যবহারকারী ধরলে এ মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন প্রায় চার কোটি মানুষ। মোবাইল অপারেটরদের তারহীন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার। করোনাকালেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেড়েছে ৪০ লাখ ৫৭ হাজার। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইনে অপরাধমূলক কর্মকান্ড। স্পর্শকাতর অনেক বিষয় মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পা রেখে অনেকে জঙ্গি ও উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ছে এমন স্পর্শকাতর তথ্যও রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাছে। সম্প্রতি এই প্ল্যাটফরমগুলো ব্যবহার করে বিদেশে নারী পাচারের মতো ঘটনা সামনে আসায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইনের কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেক আইআইজি-তে (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) সরকার কনটেন্ট ফিল্টারিং ডিভাইস বসাতে পারে। এর মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন ইউআরএল ফিল্টারিং করতে পারবে। এ ছাড়া প্রত্যেকটি সামাজিকমাধ্যমকে দেশের মধ্যে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। নিবন্ধন না নিলে বন্ধ করে দিতে হবে। নিবন্ধিত হলে দেশের আইন মেনে চলতে বাধ্য হবে। তখন ফেসবুক, ইউটিউব বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে চলা বিজ্ঞাপন থেকে সরকার সহজে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করতে পারবে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সামাজিকমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলতে জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/ছাত্রদের ফটোআইডিসহ মোবাইল নম্বর দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। নিবন্ধিত সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশিদের তথ্য অবশ্যই বাংলাদেশে রাখা সার্ভারে রাখতে হবে। অন্য কোথাও ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিতে হবে। যদি সরকার বা কোনো ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার দায়ভার ওই সামাজিক মাধ্যমকে বহন করতে হবে। প্রয়োজনে আইনের আওতায় এনে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। আর এগুলো করতে তাদের অফিস বাংলাদেশে স্থাপন জরুরি। যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের গ্রাহক অনেক, এখান থেকে ভালো আয় করছে, তাই এ ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করা সহজ।