শেখর কুমার সান্যাল
১৯৭১ সাল, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অগণিত শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ হয়েছে শত্রুমুক্ত। সবার হৃদয়ে বিজয়ের উত্তেজনা। এসেছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্জিত হয়েছে সাংস্কৃতিক স্বাধিকার। দেশে এল নাটকের জোয়ার। সূচনা হলো নাট্য আন্দোলনের, মুখ্য ভূমিকায় ঢাকার কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠী। মফস্বলের নাট্যকর্মীরা নীরব দর্শক হয়ে বসে রইল না।
নাটোরের সুদীর্ঘ নাট্যচর্চার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয় ‘সাকাম’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নাটোরের তিনজন প্রয়াত নাট্যগুরু সাদেক নবী, কালিদাস রায় ও মন্মথ প্রামাণিকের নামের আদ্যাক্ষর (সা কা ম) গৌরবের সাথে বহন করে। নাট্য আন্দোলনের পূর্ব শর্ত নিয়মিত মঞ্চায়ন। নিয়মিত মঞ্চায়নের জন্য প্রয়োজন স্থায়ী নাট্যশালা।
একসময় নাটোরে কাপুড়িয়াপট্টি কালীবাড়ি হল ছাড়া কোন মিলনায়তন ছিল না। আমি স্কুলে পড়ার সময় এখানে এডওয়ার্ড থিয়েটার প্রযোজিত ‘মিশর কুমারী’, ‘ঊষাহরণ’, ‘ক্ষুধা’, ‘ঝড়’ প্রভৃতি নাটক দেখেছি, দেখেছি ‘সমাজের বলি’ যাত্রাভিনয় নাটোরের অপেশাদার নাট্যকর্মীদের পরিবেশনায়। কানাইখালিতে আনসার হলে একটি মঞ্চ তৈরি হলে ১৯৬০ সালের দিকে নাট্যামোদী মহকুমা প্রশাসক আব্দুর রব চৌধুরীর উদ্যোগে এবং আনসার আডজুট্যান্ট আবদুল কাদের সাহেবের সক্রিয় অংশগ্রহণে ‘আর্টস কাউন্সিল’র ব্যানারে সেখানে কিছুদিন নাটক মঞ্চায়িত হতে দেখেছি। সম্ভবত ১৯৮০ সালের দিকে স্টেশান সড়কে জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম তৈরি হলেও সেখানে সাধারণত সরকারি অনুষ্ঠানাদি হতো। ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের কারণে শব্দের প্রতিধ্বনি হতো বলে নাটক মঞ্চায়নের জন্য খুব উপযোগী ছিল না। সে সময় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে স্টেজ বেঁধে অনিয়মিত নাটক মঞ্চায়নও হতো। কোন উপলক্ষ্যে মাঝে মধ্যে সৌখিন নাটক মঞ্চায়ন আর নিয়মিত মঞ্চায়ন এক কথা নয়। স্টেজ বেঁধে নিয়মিত মঞ্চায়ন ব্যয়সাপেক্ষ বলে বাস্তবসম্মত নয়।
স্থায়ী নাট্যশালার অভাব পূরণের লক্ষ্যে তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসক মোঃ গিয়াসুদ্দিন পাঠানের সহযোগিতায় ১৯৭৫ সালে শুকুলপটিতে ‘অর্পিত-সম্পত্তি’ ব্যবস্থাপনাধীন প্রাক্তন জমিদার বরদাপ্রসাদ শুকুলের একটি পোড়োবাড়ির একাংশ বার্ষিক ভিত্তিতে ইজারা নিয়ে সীমিত সামর্থ্য দিয়ে তিল তিল করে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায় বাড়ির ব্যবহারযোগ্য একটি মাত্র ঘর সংস্কার করে প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং প্রথম দিকে মহড়ার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সংলগ্ন প্রশস্ত উপাসনা কক্ষের ছাদ ভেঙে পড়ে মেঝে রাবিশে ঢেকে ছিল। রাবিশ অপসারণ করে এবং দক্ষিণের দেয়াল অপসারিত করে ঘরটিকে মঞ্চের রূপ দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে মহড়া হতো মঞ্চেই। সামনের ছাদবিহীন প্রাঙ্গণটি পরিষ্কার করে মিলনায়তন রূপে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। ‘সাকাম’-এর প্রাণপুরুষ আমিনুল হক গেদুর নিরলস নেতৃত্বে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে প্রতিষ্ঠানের শিল্পীস্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে পুরাতন টিন সংগ্রহ করে মঞ্চের সাময়িক আচ্ছাদন তৈরি করা হয়। চট দিয়ে মিলনায়তনের জন্য শামিয়ানা তৈরি করা হয়। প্রদর্শনীর পরেই তা’ খুলে গুটিয়ে রাখা হতো। বর্তমানে ‘সাকাম’ মিলনায়তনের উপর যে টিনের দোচালা স্থায়ী আচ্ছাদন তার জন্য নায়করাজ রাজ্জাকের অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। প্রদর্শনীর দিনগুলোতে পাড়ার ‘নববিধান বালিকা বিদ্যালয়’ থেকে বিকেলে বেঞ্চ আর প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে চেয়ার চেয়ে এনে শ’দেড়েক দর্শকদের আসনের ব্যবস্থা করা হতো। বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য দু’একটি সোফাও পাড়া থেকেই সংগ্রহ করা হতো। প্রদর্শনী শেষে স্কুলের বেঞ্চগুলো নাট্যকর্মীরা নিজেরাই কাঁধে করে রাত্রেই পৌঁছে দিত, চেয়ার-সোফা পরদিন সকালে। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে নাট্যকর্মী এবং উৎসাহী দর্শকেদের উৎকণ্ঠা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। সে সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ অবস্থা বর্তমানের মতো ধারাবাহিক ছিল না। সেটিও প্রদর্শনীর দিন একটি উৎকণ্ঠার কারণ হতো। তবে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণীয়।
প্রথম দিকে অনেক প্রতিকূলতা ঠেলে ‘সাকাম’কে এগিয়ে যেতে হয়েছে। অবশেষে সকল কাঁটা ধন্য করে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সাকামের নিজস্ব রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত মঞ্চায়ন শুরু হয় ১৯৭৬ সালের ৯ই মে, ১৩৮৩ সনের ২৫শে বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১১৫তম পুণ্য জন্মদিবসে কবিগুরুর গীতিনৃত্যনাট্য ‘শাপমোচন’ দিয়ে। আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে ১৯৭৬ সালের ৯ই মে ‘সাকাম’-এর প্রথম প্রযোজনার নাট্যনির্দেশনা এবং ‘সাকাম’-এর নিজস্ব রঙ্গমঞ্চে পাদপ্রদীপের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম প্রদর্শনীটি উপস্থাপনার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
প্রথম প্রদর্শনীটি ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। পরদিন থেকেই শুরু হয় দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনী। অনেক অসুবিধের মধ্যেও একটি সুবিধে ‘সাকাম’ ভোগ করত নাটোরের ঐতিহ্যগত ভাবে। নাটোরবাসীর দীর্ঘদিনের অভ্যাস দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখা। এমনকি ‘সাকামে’র নিরলস কর্মীদের পরিবারের সদস্যদেরও টিকিট কিনে নাটক দেখতে হতো (বিরল দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া)।
প্রথম মঞ্চায়ন সম্বন্ধে কিছু বলার আগে ‘সাকামে’র সাথে আমার সম্পৃক্ত হওয়ার প্রসঙ্গটি বলে নেয়া উচিত। আমি জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত ছিলাম না। স্কুলজীবনে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হলেও নাটক দেখার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা ছিল প্রায় অবাধ। সংগীত-নাটকের প্রতি আসক্তি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের অঙ্গ। বাবা শ্রীকুলেন্দ্রনাথ সান্যাল দীর্ঘকাল এডওয়ার্ড থিয়েটারের মঞ্চব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন সুগায়ক ও আবৃত্তিকার। অভিনয়ও করেছেন কয়েকটি নাটকে। মহাভারতের একটি এপিসোড নিয়ে ভট্ট নারায়ণের ‘বেণীসংহার’ নাটকে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ দৃশ্যে ভীমের ভূমিকায় বাবার দরাজ কণ্ঠে সংস্কৃত সংলাপ এখনও কানে বাজে।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি, কানাখালি মাঠে মাসব্যাপী কৃষি ও সাংস্কৃতিক একজিবিশানে একদিন এক রেস্টুরেন্টে চা খেতে খেতে স্কুলের সহপাঠী বন্ধু আবদুল হামিদ(সোনা) জানায় সাকামের নবনির্মিত রঙ্গমঞ্চ উদ্বোধন হবে আগামী ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর দিন। আমাকে অনুরোধ করে ‘সাকামে’ যোগ দিয়ে অনুষ্ঠানটির দায়িত্ব নিতে। পরদিন সন্ধ্যায় হামিদ সাকামে নিয়ে গেলে গেদুভাই আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তাঁদের অনুরোধে আমি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম। সে সময় সাকামে বেশ কয়কজন ভালো নৃত্যশিল্পী ছিল। আমি প্রস্তাব দিলাম, যেহেতু সাকাম একটি নাট্যসংস্থা, হাতে যতটা সময় আছে একটু চেষ্টা করলে কবিগুরুর ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যটি মঞ্চায়ন করা যেতে পারে। সবাই সম্মত হলেন। পরদিন সন্ধ্যায় সব শিল্পীদের সামনে আমি ‘শাপমোচন’-এর পটভূমি এবং কাহিনি বর্ণনা করলাম এবং রবীন্দ্রনৃত্যনাট্য সম্বন্ধে একটা ধারণা দিলাম। সাকামের অন্যতম উৎসাহী অভিনেতা আমার প্রাক্তন ছাত্র নিমাইচাঁদ বসাক (বিশিষ্ট বস্ত্রব্যবসায়ী) তাঁর ব্যক্তিগত জার্মান গ্রুন্ডিক টেপরেকর্ডারে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যটি সবাইকে শোনাল। তারপর শুরু হয়ে গেল জোরেশোরে প্রস্তুতি। নৃত্যপরিচালনার দায়িত্ব নিতে সম্মানীর বিনিময়ে পাবনা থেকে আনা হল নৃত্যশিক্ষক দেবেশ সান্যালকে। আমার ভাই জয়ন্ত, মিহির, শিশির, স্বপন (সংগীত শিক্ষক) ও আশিস ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে গেল সাকামের সাথে। দেবেশবাবুর নেতৃত্বে মঞ্চে নাচের প্রশিক্ষণ এবং অফিসকক্ষে স্বপনের নেতৃত্বে গানের অনুশীলন চলতে থাকল। গন্ধর্ব সৌরসেন ও লোকান্তরে গান্ধাররাজ অরুণেশ্বরের ভূমিকায় শক্তিমান অভিনেতা নাজমুল হক লালা এবং প্রেয়সী মধুশ্রী ও লোকান্তরে মদ্ররাজকন্যা কমলিকার ভূমিকায় অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী অনিতা পালকে নিবিড় অনুশীলন করালেন দেবেশ সান্যাল। উর্বশীর ভূমিকায় ছিল নৃত্যশিল্পী স্বপ্না। ইন্দ্র এবং শচীর ভূমিকায় ছিল নিমাইচাঁদ বসাক এবং ঊষা সরকার। চৈত্রসংক্রান্তিতে নাগকেশরের বনে নিভৃতনৃত্য দৃশ্যে গান্ধাররাজ অরুণেশ্বরের সখার ভূমিকায় ‘আজি দখিন-দুয়ার খোলা’ গানটির সাথে নেচেছিলেন স্বয়ং নৃত্য-পরিচালক ও কোরিওগ্রাফার শ্রীদেবেশ সান্যাল। সখিদের সম্মেলক নৃত্যে ছিল স্বপ্না বাগচী, তন্দ্রা বাগচী, কামনা দাস ও মুক্তি দাস। প্রায় তিন মাসের নিবিড় অনুশীলনে নৃত্যনাট্য ‘শাপমোচন’ মোটামুটি প্রস্তুত হলো পরিবেশনার জন্য। ১৯৭৬ সালের ৯ই মে, ১৩৮৩ সনের ২৫শে বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১১৫তম পুণ্য জন্মদিবসে কবিগুরুর গীতিনৃত্যনাট্য ‘শাপমোচন’ পরিবেশন দিয়ে ‘সাকাম’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ ও মিলনায়তনের উদ্বোধন এবং নিয়মিত মঞ্চায়ন শুরু হয়। ‘সাকাম’-এর প্রোগ্রাম ডায়েরির প্রথম পাতা থেকে তুলে আনা তথ্য -আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য।
স্থায়ী রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন
তারিখঃ ৯ই মে ১৯৭৬
সময়ঃ রাত্রি ৯টা
উদ্বোধনঃ প্রধান অতিথি জনাব গিয়াস উদ্দিন পাঠান, মহকুমা প্রশাসক, নাটোর।
সভাপতিঃ শ্রী প্রদ্যোৎ কুমার লাহড়ী, সভাপতি সাকাম।
সম্পাদকীয় ভাষণঃ জনাব আমিনুল হক গেদু, সাধারণ সম্পাদক সাকাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান“শাপমোচন”(রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য)
নৃত্য ও অভিনয়ঃ দেবেশ সান্যাল, নিমাইচাঁদ বসাক, নাজমুল হক লালা, ঊষা সরকার, স্বপ্না বাগচী, অনিতা পাল, কামনা দাস, তন্দ্রা বাগচী ও ছবি দাস।
কণ্ঠসংগীতঃ স্বপন সান্যাল, দৌলতজ্জামান, সুরজিৎ বসাক, রণজিৎ বসাক, দিলীপ মৈত্র, প্রতিমা রায়, ঊষা সরকার ও মুক্তি দাস।
ধারাবর্ণনাঃ অধ্যাপক জয়ন্ত সান্যাল, গোপালচন্দ্র ঠাকুর ও প্রতিমা রায়।
যন্ত্রসংগীতঃ শ্যামাপদ বসাক(এস্রাজ), সংগীতগুরু সন্তোষকুমার চৌধুরী(সেতার), নগেন্দ্রনাথ নট্ট(ক্ল্যারিওনেট/বাঁশি), শিশির সান্যাল(হারমোনিয়াম), আশিস সান্যাল(তবলা)।
আলোক সম্পাতঃ বিজন বিহারী চৌধুরী, স্বপনকুমার রায়।
রূপসজ্জাঃ তারাপদ পাল, ষষ্ঠীপদ পাল।
সংগীত পরিচালনাঃ স্বপন সান্যাল।
নৃত্য পরিচালনা ও কোরিওগ্রাফঃ শ্রীদেবেশ সান্যাল।
গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ অধ্যাপক শেখর কুমার সান্যাল,সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক, সাকাম।
পরিতাপের বিষয়, সে সময়ের কোন ছবি সংরক্ষিত না থাকায় পোস্ট করতে পারলাম না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, সাংস্কৃতিক সংগঠক