নিউজ ডেস্ক:
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মানুষ মানসিক চাপ ও আতঙ্কে ছিল। আশা করি, সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তা কমবে। কারণ সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অনেক অপরাধের সাজা কমানো হয়েছে। একই ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধের শাস্তির বিধান বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে আইনমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ রহিতকরণ এবং প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিনসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুরুতে এর কিছু অপব্যবহার দেখতে পাই, যা আমি অকপটে স্বীকার করতে কখনোই কুণ্ঠা বোধ করিনি।
সে সময়ে এ আইনের অপব্যবহার রোধে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করি। এ জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি দেশি-বিদেশি সংস্থা ও উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ধারাবাহিক ও দীর্ঘ আলোচনা করে। কমিটি আমাদের যে ফলাফল দিয়েছে, তাতে দেখা যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যাপক আকারে সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনা দরকার।
সেই কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ অনুমোদনের পর পাঁচ বছর পেরিয়েছে। এর মধ্যে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সারা বিশ্বে আইসিটিসংক্রান্ত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সাইবার নিরাপত্তা আইনেও নেই। সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়গুলো ১৭, ১৯ ও ৩৩ ধারায় কঠোরভাবে রেখেছি। ধর্মীয় অনুভূতির কথা প্যানেল কোডের ২৯৫ ধারায় আছে এবং সেখানে যে সাজা আছে, সেটার সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের সাজায় সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে।
কমতে পারে অজামিনযোগ্য ধারা
আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা অজামিনযোগ্য বলা হতো। সাইবার নিরাপত্তা আইনে বেশির ভাগ ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। শুধু ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ নম্বর ধারা অজামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে যেসব ধারা অজামিনযোগ্য প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলোর কিছু জামিনযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য ধারা আছে ১৪টি। নতুন আইনে আটটি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আগে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারা আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য ছিল। ফলে এখনো ছয়টি ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের সুযোগ বহাল থাকছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে অপব্যবহার ছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হলে সে অপব্যবহার বন্ধ হবে।
সমালোচনার জন্যই সমালোচনা
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইন যদি ডিজিটাল আইনের পাশাপাশি রাখা হয়, তাহলে দেখা যাবে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। এ জন্যই আমরা বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি, পরিবতন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বুধবারের আগে নতুন আইন প্রকাশ করা হয়নি। যাঁরা সমালোচনা করে বলছেন এটা নতুন বোতলে পুরনো মদ, তাঁদের উদ্দেশে বলছি, ২৯ ধারায় মানহানির মামলায় কারাদণ্ড ছিল, সেটা নেই। এখন শুধু জরিমানার বিধান করা হয়েছে। তাহলে এটা কি পরিবর্তন, নাকি একই জিনিস? ২১ ধারায় জেল ছিল ১০ বছর, এখন হয়েছে সাত বছর। এটা কি পরিবর্তন না? আইনের সব জায়গায় দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে যে উপধারা ছিল, সেগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে।’
সাইবার ক্রাইম বন্ধে এ আইন
সাইবার আইনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য সাইবার ক্রাইম বন্ধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনার অপরাধী ধরা হলে ৩৭৯ ও ৩৮০ ধারার আওতায় আনতে পারব না। কারণ তিনি সশরীরে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে চুরি করেননি। তাঁকে ধরতে হলে সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন।’
আইনবহির্ভূতভাবে ডিভাইস চেক করলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
সম্প্রতি বাসেও পারসোনাল ডিভাইস পুলিশকে চেক করতে দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয় বিষয়টি এ আইনে নিশ্চিত হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আইনবহির্ভূতভাবে পারসোনাল ডিভাইস চেক করলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এ আইনে পুলিশ ইমার্জেন্সি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ডিভাইস চেক করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে, সংঘটিত হলে বা সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করে ফেলার আশঙ্কা দেখা দিলে পুলিশ তা মনে হওয়ার কারণ লিপিবদ্ধ করে চেক করতে পারবে। এখানে বাসে পারসোনাল ডিভাইস তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ আইনবহির্ভূতভাবে চেক করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অন্য আইনেও নেওয়া যায়। পুলিশ অন্যায় করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, এমন কোনো ব্যবস্থা নেই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার ভবিষ্যৎ কী
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী এ ব্যাপারে এখনই মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, অনেক মামলা তদন্তনাধীন। অনেক মামলা কোর্টে আছে। এটা সাবজুডিস (বিচারাধীন) বিষয়। এখানে আইনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, অপরাধ যে সময়ে হয়েছে, তখন যে আইন ছিল, সেই আইনে তাকে সাজা দিতে হবে।
সরকারি কর্মকর্তাদের সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের বিধান নতুন আইনে তুলে দেওয়া সরকারি চাকরি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে কাজ করেছেন বলে ডিফেন্স নিয়ে নেন, এটা যাতে না ঘটে, সে জন্য ওই ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি চাকরি আইন বিদ্যমান আছে। আমার মনে হয় না ওই ধারা তুলে দিলে সরকারি আইনের পরিপন্থী হবে।’
সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে অংশীজনের মতামত নেওয়া হবে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘খসড়া আইনটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। বুধবার থেকে আগামী ১৪ দিন পর্যন্ত এ আইনের ওপর মতামত দেওয়া যাবে। আমরা বিবেচনা করার চেষ্টা করব।’
পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করার বিষয়ে আইনে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা নাগরিক অধিকার পরিপন্থী কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘টেকনিক্যাল অপরাধ যেসব ধারায় জামিনযোগ্য নয়, সেসব ধারায় গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। ওই ব্যক্তি আদালতে তাঁর বক্তব্য দিতে পারবেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যে মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হবে, সেই মামলায় যিনি ভুক্তভোগী হন, তাঁর ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকারের বিষয়ে কিছু বিধান সাইবার নিরাপত্তা আইনে রাখব।’
এ সময় আইন ও বিচার বিভাগের সচিব গোলাম সরোয়ার বলেন, আমলযোগ্য অপরাধে বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি করতে পারবেন, অ-আমলযোগ্য ধারায় তল্লাশি করার কোনো সুযোগ নেই।