নিউজ ডেস্ক:
‘তখন আমার বয়স মাত্র তিন বছর। বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে রেখেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, ফিরে আসবেন। আসার সময় আমার জন্য কলা আনবেন। কিন্তু বাবা আর আসলেন না। যখন বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই বাবাকে খুঁজতে শুরু করি। রাস্তায় বাবার মতো চেহারার কাউকে দেখলেই তাকিয়ে থাকি, মনে হয় উনিই আমার বাবা।
এভাবে বহুবার বহু লোককে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে তার সম্পর্কে জানতে চেয়েছি, নাম জিজ্ঞেস করেছি। গুগলে, ইউটিউবেও সার্চ করে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও বাবাকে পাইনি। তিনি কি বেঁচে আছেন, নাকি মরে গেছেন। তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল নাকি গুম করা হয়েছে, এর কিছুই জানি না। তবে বাবা যে আর ফিরবেন না, তা জানি। তবুও বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি।’
শেষ এ কথাটি বলে চোখ মুছতে মুছতে মঞ্চ থেকে নেমে শ্রোতার আসনে এসে বসেন মাকসুদা পারভীন রিনা। সেখানেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। মাকসুদা বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেট মাশরাফুল আলমের মেয়ে। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরে অভ্যুত্থানের অভিযোগে সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্যকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছিল, মাকসুদার বাবা মাশরাফুল আলম তাদের একজন। মাকসুদা শিশু বয়সেই বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
তাই অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবাকে নিয়ে মাকসুদার এমন হৃদয়বিদারক স্মৃতিচারণে মঞ্চে ও শ্রোতার আসনে উপস্থিত সকলের মনকে নাড়া দেয়। কিন্তু তাকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা যেন কারও জানা নেই। কেননা, মঞ্চ আর শ্রোতার আসনে বসা সবার গল্প একই। কেউ এসেছেন স্বামী ছাড়া ৪৫টি বছর অতিবাহিত করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার গল্প শোনাতে, কেউ এসেছেন বাবা হারা শোকের আর্তি জানাতে, কেউ এসেছেন অন্যায়ভাবে সন্তানকে হত্যার বিচার চাইতে।
মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক আলোচনা সভায় এমন করুণ চিত্র দেখা যায়। শহীদ মিনারে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী, আশপাশের ভাসমান মানুষেরাও দাঁড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তাদের নেত্রকোণেও পানি টলমল করে। আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে ১৯৭৭ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গুম ও ফাঁসির বিচারের দাবিতে সভাটির আয়োজন করে ‘খুনী জিয়া কর্তৃক রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হতভাগ্য সন্তানগণ’।
শহীদ সার্জেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের মেয়ে বিলকিস বেগমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক। আলোচক ছিলেন সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ। সভায় উপস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একেকজন মঞ্চে উঠছেন, আর চোখের পানি মুছতে মুছতে মঞ্চ ছাড়ছেন।
তারা বলছেন, কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীর শত শত সদস্যকে হত্যা করে লাশ গুম, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত করেছে। অন্যায়ভাবে যাদের ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের নির্দোষ ঘোষণা করা হোক। যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত ও সাজা দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব পদে সর্বোচ্চ র্যাঙ্কে পদোন্নতি দেখিয়ে বর্তমান স্কেলে বেতন, ভাতা ও পেনশনসহ সরকারী সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হোক। যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তাদের শহীদ হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা ও কবরস্থান চিহ্নিত করে নামসহ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হোক।
জিয়ার প্রহসনমূলক বিচারের নামে সরাসরি হত্যার শিকার পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাই ’৭৭ সালের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠনের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে খুনী জিয়ার কবর অপসারণ ও তার মরণোত্তর বিচার দাবি করছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
সভাপতির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশে গুম ও হত্যা জিয়ার হাত ধরে শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, রাষ্ট্র তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ ’৭৭ সালের অক্টোবরে বিদ্রোহের উসিলা করে পাকিস্তানী প্রভুদের খুশি করতে সে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে জিয়া। যে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, গুম ও ফাঁসি দেয়া হয়েছিল তারা অন্যায় করে থাকলেও একটা নিয়ম আছে, সেটিও মানা হয়নি। কে কতটুকু অপরাধ করেছে, সেটিও প্রমাণ করেনি।
আগেই তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার বিচার চেয়ে আমার কাছে এসেছেন, আমার মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। পরে আমি কারাগারসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাদের ফাঁসির অর্ডার হয়েছে ৩ থেকে ৬ মাস পরে। অথচ এর আগেই তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। জিয়া এসব অপরাধের হয়তো শাস্তি ভোগ করেনি। কিন্তু তার যে অপরাধ, তাতে দেশ ও জাতির প্রয়োজনে কমিশন গঠন করে জিয়ার মরণোত্তর বিচার করা হোক। এ সময় সংসদ এলাকা থেকে জিয়ার কবর অপসারণসহ ’৭৭ সালে খুনী জিয়ার গুম, ষড়যন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের সাত দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন তিনি।
সভায় সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, জিয়া কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আর্তনাদ শুনেছি। জিয়াকে যদি আবারও কোথায় পাওয়া যায়, তাকে ধরে যেন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। তাহলে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো শান্তি পাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়ার বন্দুক থেকে একটি বুলেটও বের হয়নি। তার কাজ ছিল পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করা। ফারুক, ডালিমসহ জিয়ার এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী রাষ্ট্রে পরিণত করা।
তাই মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করার সুযোগ খুঁজছিল জিয়া। ’৭৭ সালের ২ অক্টোবর সুযোগ পেয়েই প্রহসনের বিচারের নামে দেড় হাজারের অধিক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়েছে। আড়াই হাজারের মতো সেনা সদস্যকে সাজা দিয়েছে। মিনিটে একজনকে ফাঁসি দিয়েছে। বিচারের ন্যূনতম প্রক্রিয়া মানেনি জিয়া। জিয়ার নাম বাংলার মাটিতে থাকবে ঠিকই। তবে খুনী হিসেবে, হৃদয়হীন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকিস্তানী দালাল হিসেবে থাকবে। জিয়ার তখনকার কর্মকা- তদন্তে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে রিভিউ করার নির্দেশ দিতে পারেন, সেটি করা হোক। ৪ নেতা হত্যার ও ’৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিষয়েও দুটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। এসময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জিয়ার কবর অপসারণসহ তার মরণোত্তর বিচার দাবি করে সাবেক এই বিচারপতি।
মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ বলেন, দুই থেকে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল বিনা বিচারে। মৃত্যুদ- দেয়ার আগেই দ- কার্যকর করা হয়েছিল। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ৪৫ বছর আগের ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কান্না শুনে বিহ্বলিত হচ্ছি। তিনি বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আজ এখানে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধে অনেক হতাহত দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের আকুতি আমার কাছে পরিচিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের কথাবার্তা, দাবি-দাওয়ার কথা শুনতাম। সব আক্ষেপকে ছাপিয়ে তারা বিচার চান। বিচার না হলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে না। শুধু নামের মিল থাকায় তার মামা শ্বশুর বিমানবাহিনীর কর্পোরাল আমজাদ হোসেনকে ১০ দিন জেলে আটকে রাখা হয়। এরপর ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তাকে ফাঁসির অজু করানো হয়, জল্লাদ মুখে কালো কাপড় পরিয়ে মঞ্চের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় চিৎকার করে আমজাদ বলেন, আমি সেই আমজাদ নই। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের চৌকস অভিজ্ঞতায় আমজাদ ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও তিনি বাকি জীবন আর স্বাভাবিকভাবে কাটাতে পারেননি।
’৭৭ সালে যারা অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, সাজা ভোগ করেছেন তারাও তাদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা শোনান। ৪ বছর সাজা ভোগ করা সার্জেন্ট এমএ মজিদ বলেন, জিয়া ষড়যন্ত্রের বাহানা করে তাকেসহ অনেককে চাকরিচ্যুত করেছে। জেল খেটে এসে অনেক সহকর্মী জিজ্ঞেস করত, জানতে চাইত- ভাই, আমি কেন জেল খাটলাম। একজন লোক জানে না, সে কি কারণে জেল খাটল।
সভাপতির বক্তব্যে শহীদ সার্জেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের মেয়ে বিলকিস বেগম বলেন, আমার বাবাকে ১ অক্টোবর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার ছোট বোন তখন মায়ের পেটে। আমার বৃদ্ধা মা বাবার শোকে কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে গেছেন। আজও অনুষ্ঠানে আসার আগে মাকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আমার বাবাসহ যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, চাকরিচ্যুত ও সাজা দেয়া হয়েছে-এসব ঘটনায় জড়িত খুনী জিয়ার বিচার যেন হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মা এটাই জানতে চেয়েছেন, তার স্বামী দোষী নাকি নির্দোষ?।