শুক্রবার , ডিসেম্বর ২৭ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / সর্বাধুনিক রাডার বসছে শাহজালালে

সর্বাধুনিক রাডার বসছে শাহজালালে

  • ৩০ মাসে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ
  • বিমান চলাচল হবে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন

আজাদ সুলায়মান ॥ চল্লিশ বছরের পুরনো রাডার যুগের অবসান হতে চলছে। সব জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে রাডার প্রকল্প এখন অনুমোদিত। গত বৃহস্পতিবার সরকারের ক্রয় কমিটি সভায় তা অনুমোদন হবার পর এখন চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে। জুনের মাঝামাঝি বিশ্বের সর্বানুধিক রাডার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালাস কোম্পানির সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরপরই শুরু হয়ে যাবে রাডার বসানোর আনুষ্ঠানিক যাত্রা। আগামী তিন বছরেরর মধ্যেই এ রাডার

প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার টার্গেট রয়েছে। এটি বসানোর পর দেশের এভিয়েশন খাতে যোগ হবে নতুন মাইলফলক। ৬৫৮ কোটি ৪০ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে নিরাপদ বিমান চলাচল আরও নির্বিঘ্ন, নিশ্চিত ও বিশ্বমানে উন্নীত হবে। মূলত নেভিগেশন সিস্টেমকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ আকাশ চলাচলের জন্যই সিএনএস-এটিএম নামে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বিশ্বমানের থ্যালাস কোম্পানি ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমানবন্দরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রাডার প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাসম্ভব অগ্রাধিকার দেবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বহুল আলোচিত এই রাডার প্রকল্প নিয়ে অনেক নাটকীয়তা ও প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। ফ্রান্সের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে রাডার বসানোর প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। মূলত তার দূরদর্শিতার দরুন কমপক্ষে এতে দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। কেননা এই রাডার প্রকল্পটি এর আগে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি দিয়ে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়ে যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটি রাডার প্রকল্পে এতটাকা ব্যয়ের বিষয়টি সবার মনে সন্দেহ ও বির্তকের উদ্রেক করায় তা আর চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। এরপর প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সের কাছ থেকে সরাসরি জিটুজি পদ্ধতিতে রাডার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। তারপরও একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রকল্পটিকে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু দেশের স্বার্থে সিভিল এভিয়েশন, মন্ত্রণালয় ও সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহলের সজাগ দৃষ্টি ও আন্তরিক প্রচেষ্টার দরুন প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে অনুমোদন পায়।

এ সম্পর্কে বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী জানান, এই রাডার আরও অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিলম্বে হলেও প্রকল্প শেষ পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে এটা অবশ্যই সিভিল এভিয়েশনের ইতিহাসে অন্যতম মাইলফলক। আগের প্রকল্পের চেয়ে বর্তমান প্রকল্পের মাধ্যমে রাডার সংগ্রহ করা হলে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। প্রকল্পটি হলে সরকারের ‘ভিশন-২১’ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে আরও একধাপ। নিরাপদ হবে দেশের আকাশসীমা ও বিমান চলাচল ব্যবস্থা।

জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন- এ রাডার বসানোর পর দেশের এভিয়েশন খাতের রাজস্বই বেড়ে যাবে। একদিকে নিরাপদ বিমান চলাচল অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবেও স্বীকৃতি পাবে।

বেবিচক জানিয়েছে এই রাডারের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক আগেই। কেননা দীর্ঘদিনের পুরাতন রাডার দিয়ে দেশের পূর্ণ সীমানা নিয়ন্ত্রণে কাভার করে না। ফলে অন্য কোন দেশের বিমান থেকে আকাশপথের রাজস্ব ও জরিমানা আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে পেলেও সুফল মিলছিল না।

বহুল প্রতীক্ষিত রাডার প্রকল্প নিয়ে যিনি দীর্ঘদিন ধরেই নিষ্ঠা ও মেধার সমন্বয়ে কাজ করে সফলতার মুখ দেখতে যাচ্ছেন সেই কর্মকর্তা বেবিচকের মেম্বার (এফএসআর ) গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, সবকিছুৃ ঠিক থাকলে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি করার টার্গেট রয়েছে। তারপর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে। অনুমোদন হয়ে যাওয়ার পর এখন শুধু রাডার বসানোর দৃশ্য দেখার অপেক্ষা।

জানা গেছে বিশ্বের সর্বাধুনিক এই রাডার প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ওয়াম সার্ভিলেন্স অব ইইজেড, এইচ এফ ট্রান্সমিটার, থ্রিডি টাওয়ার সিমুলেটর, নাভায়েডস, কন্ট্রোলার্স রোস্টার ম্যানেজমেন্ট টুল বিজেড টুলস। এটি আধুনিক রাডার ও নেভিগেশন সিস্টেম হিসেবে পরিচিত। নিরাপদ বিমান চলাচল নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী অত্যাধুনিক রাডার প্রযুক্তি আবশ্যক। বাংলাদেশের আকাশসীমায় বিমান চলাচল নিরাপদ রাখতে এ ধরনের অত্যাধুনিক মানের রাডার স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইকাওর। এটা বাস্তবায়ন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রততম সময়ে রাডার প্রকল্প করা হচ্ছে। বছর কয়েক ধরে এ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হলে নানা বিতর্কও দেখা দেয়। বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে প্রায় তিনগুণ দামে বছর তিনেক আগে একটি কোম্পানি রাডার বসানোর প্রস্তাব দিলে চরম বির্তক দেখা দেয়। এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তা বাতিল করে দেন এবং ফ্রান্সের কাছ থেকে সরাসরি জিটুজি পদ্ধতিতে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় রাডার সংগ্রহের পরামর্শ দেন। এরপর ফ্রান্সের থ্যালাস নামে কোম্পানির কাছ থেকে রাডার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

জানতে চাইলে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, নিরাপদ বিমান চলাচলের জন্য রাডার ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম প্রধান বিবেচ্য স্থাপনা। এভিয়েশন জগত যতটা এগোচ্ছে রাডার ও ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমও ততই আধুনিক হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিভিল এভিয়েশনও হাতে নিয়েছে বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত এ প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে চলাচলকারী অনেক বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ এর আওতায় আসবে। এতে শুধু রাডার ব্যবস্থাপনার কারণেই বেড়ে যাবে সিভিল এভিয়েশনের রাজস্ব। সেইসঙ্গে নিশ্চিত হবে নিরাপদ আকাশপথ।

এ রাডার কোথায় বসানো হবে প্রশ্ন করা হলে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন প্রাথমিকভাবে বর্তমান ভিআইপি গেটের পাশেই ছিল। কিন্তু আমাদের পছন্দের জায়গা হচ্ছে বলাকা ভবনের সামনে যাতে এমন একটি দৃষ্টিনন্দন টাওয়ার সবার নজর কাড়ে। বর্তমানে এখানে সয়েল টেস্ট চলছে। বলাকার পাশে হলে টাওয়ারের উচ্চতা করা যাবে ৫৫ মিটার। সবদিক থেকেই এটা বেস্ট সাইট।

কবে নাগাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি আগামী ১০ জুনের মধ্যেই চুক্তি করার।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমান বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি রাডার নির্মাতা কোম্পানির মধ্যে ফ্রান্সের থ্যালাস সবার শীর্ষে। পৃথিবীর বেশি অত্যাধুনিক বিমানবন্দরের মধ্যে অধিকাংশই থ্যালাসের রাডার ব্যবহার করছে। থ্যালাস বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ সফল উৎক্ষেপণ করে। এর আগে ১৯৮০ সালেও জিটুজি’র ভিত্তিতে থ্যালাস বাংলাদেশে রাডার ও নেভিগেশন সিস্টেম চালু করে, যা এখন পর্যন্ত চালু রয়েছে ও বিমানের নিরাপদ উড্ডয়ন অবতরণ নিশ্চিত করছে। বর্তমান এই রাডার প্রকল্পের শুরুতেই এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে বেবিচক। কেননা ২০০৫ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুরনো রাডার প্রতিস্থাপনে উদ্যোগ নেয় বেবিচক। ২০১২ সালে পিপিপির আওতায় রাডার স্থাপন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিলে ১৫ সালে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানোয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় তা বাতিল করে দেয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ১৭ সালের ১ মার্চ পিপিপির পরিবর্তে সরকারী অর্থায়নে সাপ্লাই ইনস্টলেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন অব মাল্টি-মোড সার্ভিলেন্স সিস্টেম (রাডার, এডিএস-বি) এটিএস এ্যান্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করে। এ প্রকল্পেরই নতুন নামকরণ করা হয়েছে সিএনএস-এটিএম প্রকল্প। এর আগে মন্ত্রিসভা কমিটিতে পিপিপির প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দর প্রস্তাব করা হয়েছিল ২১৭৫ কোটি টাকা। যা এতে প্রস্তাবিত সুবিধা ও যন্ত্রপাতির মূল্য বিবেচনায় অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় মন্ত্রিপরিষদ সেটি অনুমোদন করেনি। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হলে তিনি তা বাতিল করে আরও বিবেচনার নির্দেশ দেন এবং ফ্রান্সের থ্যালাস কোম্পানি থেকে সরাসরি জিটুজি পদ্ধতিতে রাডার কেনার পরামর্শ দেন। সে অনুসারে সিভিল এভিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসানের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি জিটুজি’র ভিত্তিতে ফ্রান্সের থ্যালাসের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপরই ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘থ্যালাস’-এ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও দর প্রস্তাব করে। এতে দেখা গেছে, পিপিপিতে উল্লেখিত যন্ত্রপাতি ছাড়াও অতিরিক্ত আরও ৮০ কোটি টাকার নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি সংযোজনের পরও তাদের প্রস্তাবিত নতুন দর দাঁড়ায় আনুমানিক ৬৫০ কোটি টাকা যা আগের প্রস্তাবিত দরের তুলনায় প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা কম। অন্যদিকে আগের প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতির সঙ্গে অতিরিক্ত আরও যোগ হয়েছে ওয়াম সার্ভিলেন্স সিস্টেম আগের প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতির সঙ্গে অতিরিক্ত আরও যোগ হয়েছে ওয়াম সার্ভিলেন্স অব ইইজেড, এইচ এফ ট্রান্সমিটার, থ্রিডি টাওয়ার সিমুলেটর, নাভায়েডস, কন্ট্রোলার্স রোস্টার ম্যানেজমেন্ট টুল বিজেড টুলস। এ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন- প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে-এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার এ্যান্ড কন্ট্রোল টাওয়ার নামক প্রকল্পটিতে ব্যাপক সাশ্রয় হচ্ছে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় দেড় হাজার কোটি।

কবে নাগাদ রাডার বসানো সম্ভব হবে জানতে চাইলে গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, চুক্তি অনুসারে সবকিছু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে আগামী ৩০ মাসের মধ্যেই প্রকল্পটির সব কাজ সম্পন্ন করা যাবে।

আরও দেখুন

বাগাতিপাড়ায় আগুনে পোড়া তিন পরিবার পেল সহায়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক বাগাতিপাড়া,,,,,,,,,,,,,নাটোরের বাগাতিপাড়ায় আগুনে পুড়ে যাওয়া ৩টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে …