নিউজ ডেস্ক:
যানজটের শহরে পাতাল রেল স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ষ বাঁচবে কর্মঘণ্টা দুর্ভোগ থেকে রেহাই মিলবে কর্মজীবীদের পাতাল রেল তরুণ প্রজন্মের কাছে একটা স্বপ্নের প্রকল্প : সড়ক পরিব
চার হাজার বছরের পুরাতন শহর ঢাকা। বর্তমানে এই শহরে দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। কাজের খোঁজে এখানে প্রতিদিন আসেন প্রায় ২৫-৩০ হাজার মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে এই সড়কেই। যানজটে নগরবাসীর প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দিনে প্রায় ১০০ কেটি টাকার বেশি ক্ষতি হয় এই যানজটে। আর তাই বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় অযোগ্য শহর হিসেবে চতুর্থ অবস্থানে ঢাকা। বসবাসযোগ্যতা ও নাগরিক সুবিধাগত দিক থেকে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর অবস্থান বিষয়ক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) সা¤প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। সম্প্রতি বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বের ১৪০ শহরের এ তালিকাটি প্রকাশ করে ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তালিকায় ১৩৭তম স্থানে জায়গা করে নেয় ঢাকা।
রাজধানী ঢাকার এই যানজট কমাতে সর্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ নতুন নতুন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার যানজটকে আরও কমাতে রাজধানীর লাখ লাখ মানুষের স্বাচ্ছন্দে চলাচলের উদ্দেশে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাটির নিচে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরির পরিকল্পনা করছে সরকার। যা বাংলাদেশের ইতহাসে প্রথম। এতে কমবে যানজট ও জনজট। বাঁচবে কর্মঘণ্টা, দুর্ভোগ থেকেও রেহাই মিলবে কর্মজীবী মানুষের।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাতালরেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। যদিও ২০২১-এর অক্টোবরে এই যাচাই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা তবে কর্মকর্তারা ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়েছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ লাখ কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করতে পারবেন। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাটির নিচে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নে আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, কাজের প্রক্রিয়া ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারণের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে পাতাল রেলের চারটি রুটের নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ঢাকা মহানগরীতে পাতাল রেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে এই তথ্য জানানো হয়েছে। সাবওয়ে বা পাতাল রেলের নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সাবওয়ের ১১টি লাইনের মধ্যে চারটি লাইনের কাজ শেষ হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। রুটগুলো হলো টঙ্গী থেকে কেরানিগঞ্জের ঝিলমিল প্রজেক্ট, সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে কামরাঙ্গীর চর, উত্তরা ১৩ সেক্টর থেকে নারায়ণগঞ্জ এবং গাবতলী থেকে মাস্তুল পর্যন্ত। বাকি সাতটি লাইনের কাজ শেষ হবে ২০৪০ সালের মধ্যে।
পাতাল রেল নির্মাণে টানেল খননে অত্যাধুনিক টানেল বোরিং মেশিন ব্যবহৃত হয় বলে নির্মাণকালীন জনদুর্ভোগ খুবই কম। পরিবেশ বিপর্যয়ও হয় না বললেই চলে। সাবওয়ে নির্মিত হলে জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করবে। ফলশ্রুতিতে ভূমির উপরিভাগে জনসংখ্যার চলাচল কমবে। ঢাকায় যানজট কমে আসবে। সড়কপথে যেখানে ঘণ্টায় ১০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারেন, সেখানে পাতাল রেলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। উড়াল সেতুর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ৫০ থেকে ৭৫ বছর হলেও পাতাল রেলের স্থায়িত্বকাল প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর হবে। ঢাকার তলদেশ ও ভ‚মির বৈশিষ্ট্য পাতাল রেল নির্মাণের উপযোগী, যা জাপানের ওসাকা শহরের অনুরূপ। এ কারণে ওসাকা শহরের মতোই রাজধানীতে মাটির ২০ থেকে ২৫ মিটার গভীরে পাতাল রেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় সরকার। প্রথমে ঢাকার পাতাল রেল পথ নির্মাণের লক্ষ্যে চারটি রুট চিহ্নিত করেছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন চারটি রুটের পরিবর্তে একাধিক পাতাল রেল রুট নির্মাণ করা হবে। এজন্য প্রাথমিকভাবে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প সংশোধন করে সরকার।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) মতো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তৈরির বিষয়টি সেতু বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনায় আসে। কর্মকর্তারা জানান, পাতাল রেলের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির বিষয়টি শেষ পর্যায়ে আছে এবং এ নির্মাণকাজের জন্য একটি আলাদা কোম্পানি প্রয়োজন। বিবিএ পাতালরেল নির্মাণের উদ্যোগকে কৌশলগত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। প্রকল্পের পরামর্শকরা জানান, মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের সহায়ক হিসেবে পাতালরেল নেটওয়ার্কও নির্মাণ করা উচিৎ।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, ২০২৬ সালে পাতাল রেলে যাত্রী পরিবহন শুরু হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে প্রথম প্যাকেজে ডিপোর ভূমি উন্নয়ন ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জে ডিপো নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। ঢাকায় পাতালরেলের জন্য ২৫টি ট্রেন কেনা হবে। প্রতিটি ট্রেনে আটটি করে কোচ থাকবে। একেকটি ট্রেনে একসঙ্গে তিন হাজার ৮৮ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। রেললাইনটি নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
বিবিএ সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমানে পাতালরেল নেটওয়ার্ক তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। প্রকল্পের খসড়া সম্ভাব্যতা যাচাই নিরীক্ষা চলতি বছরের মার্চে জমা দেয়া হয়েছে। খসড়ায় ঢাকার যানবাহনের চাপ কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে মাটির নিচে ২৫৮ কি.মি. রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাতালরেলের জন্য একটি আলাদা কোম্পানি গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ঢাকা শহর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে ১১টি পাতালরেল রুট চালু করা হবে।
৫০ বছর মেয়াদী এ পরিকল্পনা ৩টি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ১০২ কিমি দৈর্ঘ্যরে ৪টি রুট নির্মাণ করা হবে। ২য় ও ৩য় পর্যায়ে মাটির নিচ দিয়ে যথাক্রমে ৮৫ ও ৭১ কিমি দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণ করা হবে। ২৯ দশমিক ৩৫ কিমি দীর্ঘ রুট কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প এলাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এই রুট সবার আগে বাস্তবায়িত হবে। এতে প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরামর্শক হিসেবে স্পেনের টিপসা’র নেতৃত্বে জাপানের পেডিকো, বিসিএল অ্যাসোসিয়েটস, কেএসসি ও বেটসকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকায় পাতালরেল নেটওয়ার্কের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১টি রুটের অ্যালাইনমেন্ট প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চারটি রুটে এ রেলপথ নির্মাণ হবে।
প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার দেয়া চারটি রুটে পাতাল রেল নির্মাণ করতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। যে চারটি রুটে প্রাথমিকভাবে পাতাল রেলপথ নির্মাণ হবে তার মধ্যে ঝিলমিল থেকে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার, শাহকবির মাজার রোড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার, কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে।
এরমধ্যে গাবতলী থেকে ভোলাব, কেরানীগঞ্জ থেকে পূর্ব নন্দীপাড়া, গাবতলী থেকে বসুন্ধরা রিভারভিউ, হাজারীবাগ থেকে পূর্বাচল, ঝিলমিল থেকে টঙ্গী জংশন ও, শাহ কবির মাজার রোড থেকে সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ, তেঘরিয়া বাজার থেকে বন্দর, টঙ্গী জংশন থেকে কোনাবাড়ি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাবতলী চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পুরো পাতালরেল নেটওয়ার্কে স্টেশনের সংখ্যা হবে ২১৫টি।
চুক্তি অনুযায়ী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে ২৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ ৯০ কিলোমিটারের নির্মাণকাজের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পায়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমীক্ষা শেষে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে (পাতাল রেল) নির্মাণের প্রস্তাবনা বাংলাদেশ সেতু বিভাগে দাখিল করে। পাতালরেলের জন্য নির্মাণ হবে টানেল। এসব টানেল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০ মিটার নিচ দিয়ে যাবে। ফলে জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণজনিত কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. শামছুল হক বলেন, পাতাল রেল বা সাবওয়ে চালুর সুপারিশ অনেক আগেই করা হয়েছিল। ঢাকার যানজট থেকে মুক্তির জন্য সাবওয়ে বা পাতালরেল হলো খন্ডিত উন্নয়ন। এককভাবে শুধু পাতাল রেল হলেই যানজট নিরসন হবে না। এই শহরের যানজট মুক্ত করতে হলে গণপরিবহন, সিগন্যালসহ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন করতে হবে। কারো কারো চোখে হয়ত এমন দেখেন যে, পাতাল রেল হলেই ঢাকার যানজট মুক্ত হয়ে যাবে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান হয়তো এতে লাভবান হবে। তবে এগুলো যেন বৃত্তাকার রেলপথ, মেট্রোরেলসহ অন্য প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, সেদিকে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে।
পাতাল রেল প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিমানবন্দর ও কমলাপুর রুটে দেশের প্রথম পাতাল রেল হবে। পাতাল রেল নির্মাণে কোনো ভোগান্তি হবে না। নির্মাণাধীন পদ্মাসেতু ও মেট্রোরেলের মতো এটাও তরুণ প্রজন্মের কাছে একটা স্বপ্নের প্রকল্প।