নিউজ ডেস্ক:
রাজধানী ঢাকার বাইরেও মেট্রোরেল সেবা সম্প্রসারিত করতে চায় সরকার। ঢাকা জেলার পার্শ্ববর্তী কিছু শহর ও উপশহর এলাকায় এ সম্প্রসারণের কাজ করা হবে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার কিছু পয়েন্ট অগ্রাধিকার তালিকায় আছে। ধীরে ধীরে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যেই রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ মিলিয়ে ৬টি রুটে চলবে মেট্রোরেল।
লাইন ৬-এর আওতায় শেষের পথে উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশের কাজ। এর পরেই লাইন এক ও পাঁচের কাজও শুরু হবে চলতি বছর। চলতি বছরেই বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও। আসছে বছর বর্ধিত হবে মতিঝিলে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এবং ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এসব এলাকায় মেট্রোর রুট বসানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজ করছে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ফান্ড ফর পোভার্টি রিডাকশনের (জেএফপিআর) সহায়তায় সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) হালনাগাদ করার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে ডিটিসিএ।
জানা যায়, যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ এর বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোরেলের জন্য বাড়তি সোয়া কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করতে গেলে দুটি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় ছয় একর জমি তাদের অধিগ্রহণ করতে হবে। এ জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের জন্য ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা খরচ পড়বে। বাকি টাকা খরচ হবে অবকাঠামো নির্মাণে। এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
মেট্রোরেল লাইন ছয় শীর্ষক এ প্রকল্প প্রথম অনুমোদন পায় ২০১২ সালে। এক দশক পর এসে রেললাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানোসহ নতুন কিছু কাজ যোগ করতে চায় ডিএমটিসিএল। এ ছাড়া বাড়তি আয়ের জন্য নতুন করে তিনটি স্টেশন প্লাজা ও ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) করতে চায় সংস্থাটি। যাত্রীদের টিকিটের মূল্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিপণিবিতান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বাড়তি এসব কাজ যুক্ত করায় প্রকল্পের ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে একলাফে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকায় উন্নীত হবে। অর্থাৎ মেট্রোরেলের ব্যয় বাড়ছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের সার্বিক ব্যয় মেটাতে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেবে। বাকি ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার জোগান দেবে সরকার। প্রকল্পটিতে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে তিনটি স্টেশন প্লাজার জন্য সোয়া ছয় হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা ও তিনটি স্টেশন প্লাজা নির্মাণে ৯৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) নির্মাণে খরচ হবে ৮৬৬ কোটি টাকা।
বাকি ৭ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত সোয়া কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা, রেললাইন নির্মাণের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) বাবদ ৩৪৬ কোটি টাকা এবং বৈদ্যুতিক ও মেকানিক্যাল ব্যবস্থা (ইঅ্যান্ডএম) স্থাপনে ৩২২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোরেলের ট্রায়াল রান বা পরীক্ষামূলক চলাচলের জন্য বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা থাকলে জমি অধিগ্রহণে বাড়তি এ টাকা খরচ করতে হতো না।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৫ সালে প্রণয়ন করা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এস্টিপি) এ লাইনটি ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাইপাইল পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ছিল। একইভাবে হেমায়েতপুর থেকে মিরপুর-১০, কচুক্ষেত বনানী হয়ে ভাটারা পর্যন্ত নির্মাণাধীন এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর) প্রকল্পটিও বাইপাইল পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ অবস্থায় এমআরটি লাইন-৬ এর আওতায় আশুলিয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় ২০১৬ সালে প্রক্রিয়া করা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি)।
বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রো লাইনটি গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকলেও একই লাইনে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ায় এ পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। এ অবস্থায় হালনাগাদ পরিকল্পনায় এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পটি গাজীপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব রাখা হবে। এর ফলে ২১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে লাইনটি উন্নীত হবে ৪১ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। আর দৈনিক যাত্রী পরিবহণের সক্ষমতা ৪ দশমিক ৮৩ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ দশমিক ১৭ লাখে। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে প্রকল্প অনুমোদনের পর হেমায়েতপুর থেকে মিরপুর-১০, হয়ে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী বছর। এ লাইনটি পশ্চিম দিকে বাইপাইল পর্যন্ত আর পূর্ব দিকে রূপগঞ্জ হয়ে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের ভূলতা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এর মাধ্যমে লাইনটির দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬০ কিলোমিটার।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ১২৯ দশমিক ৯০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণের গতিপথ চূড়ান্ত রয়েছে। এর মধ্যে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৪ প্রকল্পটিও রয়েছে। প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলেই গাজীপুর চৌরাস্তা, সাভারের বাইপাইল, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও বরপা, কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত মেট্রো রেল নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এর ফলে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য আড়াইশ’ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। মেট্রোরেল প্রকল্পের শুরু থেকেই কমলাপুর পর্যন্ত রেললাইন করার চিন্তা ছিল। কিন্তু রুট নির্ধারণ না হওয়ায় তখন করা যায়নি। এখন রুট নির্ধারণ করা গেছে। জমি অধিগ্রহণে এক হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। কারণ, সেখানে ব্যক্তিগত জমি আছে। স্থাপনাও আছে। জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন যেসব তথ্য চেয়েছে, তার সবই দেয়া হবে।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে যানজটের পরিমাণ কমিয়ে আনা। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকা মেট্রোরেলের আওতায় আনা হবে। এর ফলে ঢাকা শহরের ওপর জনগণের চাপ কমে আসবে। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এখন বিভিন্ন এলাকার জনগণকে ঢাকা শহরের দিকে টানছে। আশেপাশের জেলার মানুষ সেখান থেকেই প্রতিদিন ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মামুন আল রশীদ বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য বাড়তি যে জমি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, আমরা তার বিস্তারিত জানতে ডিএমটিসিএলকে চিঠি দিয়েছি। কোন মৌজায়, কোন দাগে জমি অধিগ্রহণ করা হবে, তার কিছুই জানায়নি তারা। কিসের ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণ বাবদ এক হাজার কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণ, ছোট শহর ও পল্লী এলাকায় থাকতে লোকজনকে উৎসাহ দিতে মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প নেয়া উচিত। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছোট বিনিয়োগের মাধ্যমেই রাজধানীর যানজট নিরসনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।