- প্রধানমন্ত্রী ঈদ উপহার হিসেবে আরও প্রায় ৩৩ হাজার পরিবারকে বিনামূল্যে জমি ও ঘর দিলেন
- বললেন, ‘আমার কাছে ক্ষমতাটা হচ্ছে জনগণের সেবা করা’
‘ঈদ উপহার’ হিসেবে আরও প্রায় ৩৩ হাজার পরিবারকে বিনামূল্যে নতুন ঘর প্রদানের সময় নিজস্ব ঠিকানা পাওয়া মানুষের মুখের হাসি দেখে নিজের আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার সব থেকে ভাল লাগে যখন ঘর পাওয়ার পর কোন মানুষের মুখের হাসিটি দেখি। জাতির পিতা তো দুঃখী মানুষের মুখেই হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। সব মানুষ যেন মানুষের মতো বাঁচতে পারে, সুন্দর জীবন পেতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। সে জন্য এই কাজটি আমরা করব, যাতে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে পারে।
তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন, ভূমিহীন এবং ঠিকানাবিহীন থাকবে না। আমরা সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। তার সরকার একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে জাতির পিতার লালিত স্বপ্ন পূরণে সবার মুখে হাসি ফোটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, বাংলাদেশ উন্নত হোক- যারা স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করতে চেয়েছিল, তারা এখনও রয়ে গেছে, যারা কখনও এটা চাইবে না। কিন্তু সকল বাধা অতিক্রম করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে এবং আমরা এগিয়ে যাব।
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার তার সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আরও বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ৩২ হাজার ৪শ’ ৯টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারের মাঝে জমি ও ঘর দিয়েছি। আমি আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরের উপহার হিসেবে আজ এসব জমি ও ঘর দিয়েছি। যারা ঘর পেয়েছে, তাদের মুখের হাসি আমি খুব পছন্দ করি। তিনি বলেন, বেদে, তৃতীয় লিঙ্গ, চা-শ্রমিক, কুষ্ঠ রোগী, ভিন্নভাবে সক্ষমসহ সুবিধাবঞ্চিত সকল শ্রেণীর মানুষকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে গৃহায়ণ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। আর এ জন্য সরকার শুধু খাস জমিরই খোঁজ করছে না, নিজেদের অর্থায়নে জমি কিনেও ঘরবাড়ি করে দিচ্ছে।
মুজিববর্ষে সারাদেশে প্রতিটি ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে বাসস্থানের আওতায় আনার সরকারী অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে আশ্রয়ণ-২ আওতায় তিন ধাপে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৩টি বাড়ি বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এবং আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়। উপকারভোগীদের দুই শতক জমিতে টিনশেড আধা-পাকা ঘর প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি নবনির্মিত বাড়ির দলিল ও চাবি বিতরণ করেন।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস মানুষকে একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে যে, ধন-সম্পদ-অর্থ এগুলো কিছুই না। আর মরলে তো সব রেখেই যাবেন। কবরে কিছু নিয়ে যেতে পারবেন না। কাজেই সম্পদের পিছে ছুটে নিজেকে মানুষের কাছে অসম্মানের জায়গায় রাখার কোন মানে হয় না। বরং দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। তাই বলছি দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ান।
জাতির পিতার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের পদাঙ্ক অনুসরণে ’৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর পরই এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় উল্লেখ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ’৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়-ক্ষতি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া টেরই পাননি। কারণ তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে ’৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপটে তিনি তার বিদেশ সফর বাতিল করে জরুরী ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করে মানুষকে সহযোগিতায় নেমে পড়েন এবং নিজে বিভিন্ন জায়গায় যান।
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার সবচেয়ে ভাঠ লাগে যখন দেখি একটা মানুষ ঘর পাওয়ার পর তার মুখের হাসি। জাতির পিতা দুঃখী মানুষের মুখেই হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। সকল মানুষ যাতে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সে লক্ষ্য নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাই আমরা চালিয়ে যাব। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদমযাপনকালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের যে স্বীকৃতি পেয়েছি, তাকে ধরে রেখে উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে জাতি বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে, সে জাতি কখনও পিছিয়ে থাকতে পারে না। শহীদের রক্ত কখনও বৃথা যেতে পারে না। ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশকে পিছিয়ে দেয়ার এবং স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত করার যে ষড়যন্ত্র, তা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারাটাই সব থেকে বড় প্রাপ্তি বলেও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।
দলের নেতাকর্মীদের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলব, জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে চলবে। দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াবে- এটাই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। একটা মানুষকে যদি একটু আশ্রয় দেয়া যায়, তার মুখে হাসি ফোটানো যায়, এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন রাজনীতিবিদের জীবনে আর কী হতে পারে? এটাই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের সময়ই আপনারা দেখেছেন, অর্থবিত্ত, সম্পদ কাজে লাগে না। সে সময় অনেক হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার মালিকেরও কিছুই কিন্তু করার ছিল না। যারা বাংলাদেশে কোন দিন চিকিৎসাই নেয়নি, তাদেরকেও এই দেশেই ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, সারাবিশে^ লকডাউনের কারণে টাকা থাকলেও এসব ধনীরা দেশের বাইরে যেতে পারেননি। অথচ অতীতে একটু সর্দি-কাশিতেও তারা দেশে চিকিৎসা না নিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় অনেক উন্নত দেশ না পারলেও তৃতীয় বিশে^র একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে দেশবাসীকে বিনামূল্যে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন এবং প্রয়োজনীয় করোনা চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে প্রদানে তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় পৃথিবীর কোন দেশ এইভাবে মানুষকে সম্পৃক্ত করে এ রকম দুর্যোগকালীন একযোগে কাজ করতে পারেনি, যেটা বাংলাদেশে আমরা করতে পেরেছি। যে কারণে আমরা আজকে হয়তো করোনার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি।
দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলাতেও এভাবেই দেশবাসীকে একযোগে কাজ করে যাওয়ার আহ্বানের পাশাপাশি বিশে^র বিভিন্ন দেশে আবারও করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় সকলকে এ সময় সতর্ক থাকার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করা হয়, আর দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষের দেশ কেউ বলে না, অবহেলার চোখে কেউ দেখে না। আর এটা সম্ভব হয়েছে এ দেশের মানুষের জন্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বারবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেয়াতেই আজকের দেশের দৃশ্যমান এত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে এ জন্য দেশবাসীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতা পুনর্ব্যক্ত করেন। দেশবাসীকে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে কাছে-দূরের সকলেই তার হৃদয়ে রয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে সকলের কল্যাণ কামনার পাশাপাশি জনগণকে আশ^স্ত করে তিনি বলেন, ‘নিজেদের জীবনকে নিজেরা গড়ে তোলেন। আমরা আছি আপনাদের পাশে। জাতির পিতার স্বপ্ন ইনশাল্লাহ আমরা পুরণ করব।’
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানিয়েছিলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ২ শতক জমির সঙ্গে ঘর পেয়েছেন দেশের ভূমি ও গৃহহীন প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯ পরিবার। দেশে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ‘আশ্রয়ণ’ নামে প্রকল্প নেয়া হয়। এর আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে বলে জানান সচিব।
আশ্রয়ণ-২ এর তৃতীয় পর্বে বাড়িগুলোকে আরও টেকসই এবং জলবায়ু সহনশীল করতে সরকার খরচ বাড়িয়েছে এবং নক্সায় পরিবর্তন এনেছে। বাড়িগুলোকে আরও টেকসই করতে প্রতিটি বাড়ির জন্য খরচে এক লাখ ৯১ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। সরকার বাড়িগুলোকে আরও টেকসই করার জন্য শক্তিশালী গ্রেট-বিম, নিন্টেল এবং আরসিসি পিলার বিশিষ্ট বাড়িগুলো নির্মাণ করেছে। যেগুলো মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিস্ট্রি দলিলসহ বিনামূল্যে ৩৩ হাজার পরিবারকে হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী।