নিউজ ডেস্ক:
গত ৩ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর আচমকা হামলা করে অস্ত্রধারীরা। ৫০-৬০ জনের ওই অস্ত্রধারী দলটি কাঁটাতারের বেড়া কেটে মেটেরিয়াল ইয়ার্ডের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে। নিরাপত্তাকর্মীদের আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করে তাদের কাছে থাকা মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। তাদের চিৎকারে আনসার সদস্যরা এগিয়ে এলে অস্ত্রধারীরা তাদের ওপরও হামলা করে। একপর্যায়ে আনসার সদস্যরা গুলি ছুড়লে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো কেপিআই (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) প্রতিষ্ঠানে এমন হামলার ঘটনা সরকারের শীর্ষ মহলের ভাবনায় আঘাত হানে।
এর দুই দিন পর নরসিংদীর রায়পুরায় দিনদুপুরে নগদ (মোবাইল ব্যাংকিং সেবা)-এর দুই কর্মীকে গুলি করে ৬০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের হাসনাবাদ বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা নগদের এজেন্ট স্টাফ সুপারভাইজার দেলোয়ার হোসেনের (৫০) পেটে এবং মোটরসাইকেলের পেছনে বসা মাঠকর্মী শাহিন মিয়ার (২৫) ডান হাতে গুলি করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।
এই দুই ঘটনার বাইরে গত পাঁচ দিনে বান্দরবানে পরপর কয়েকটি হামলা, ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ, গোলাগুলি ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় দেশব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বান্দরবানের কুকি-চিন নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক ইন্ধন রয়েছে কি না- বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে সরকারের শীর্ষ মহল। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশের সব ইউনিটে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। সীমান্তে আরও সতর্ক থাকতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদর দফতর। বিষয়টি নিয়ে গতকাল কথা হয় পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পুলিশ সদর দফতরের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে পুলিশের সব ইউনিটে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ঈদুল ফিতরের সময়টায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতীতের মতো করেই বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অপরাধ দেখা হলে ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখতে হবে দেশবাসীকে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখার সময় এসেছে। সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ বেড়ে গেছে ডাকাতির ঘটনা। বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি বড় স্থাপনাগুলোতে ডাকাতির টার্গেট করা হচ্ছে। সম্প্রতি বান্দরবানের রুমা বাজার ও থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে কেএনএফের ডাকাতি ও অপহরণের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। এর পাশাপাশি মঙ্গলবার কুষ্টিয়ায় ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট শাখার ভল্ট থেকে ৫ লাখ টাকা চুরির ঘটনাকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বাগেরহাটের রামপালে তাপবিদুৎ কেন্দ্রে হামলার ঘটনায় নিরাপত্তাব্যবস্থা নাজুকের বিষয়টি ইঙ্গিত করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর বাইরে অতি সম্প্রতি রাজধানীর ডেমরা এলাকায় ১৪টি বাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একের পর এক ঘটেই চলছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। অপহরণ, হত্যা, ব্যাংক ডাকাতি, অগ্নিসন্ত্রাস, লুটতরাজসহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দূরত্ব ও ঐক্যের অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যখন কোনো প্রশ্ন থেকে যায়, সেই প্রশ্ন অনেক অপরাধ বা ঘটনার জন্ম দেয়। যেটি মানুষের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত তৈরি করে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন, রাজনৈতিক মোড়কে বিবেচনা ও রাজনৈতিক কারণে জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখানে দেশের ক্ষতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট, মানুষকে জিম্মি করা, সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি করা- এগুলো যে দেশের বিষয়, এই বোধটুকু আমাদের অনেক জনগণের মধ্যে নেই। রাজনৈতিক বিভাজন থাকতেই পারে। তবে দেশ আমাদের সবার- এটি ভাবতে হবে। দেশের ক্ষতি হলে সেটি সবার ক্ষতি- এই বোধ জনগণের মধ্যে তৈরি করতে হবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি স্থাপনায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন করার সময় সংশ্লিষ্ট থানার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ নাগরিকদের। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে। রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং বিপণি বিতানগুলোতে পুলিশি টহল থাকবে। একই সঙ্গে সব চিহ্নিত অপরাধীকে বিশেষ নজরদারিতে রাখতে বলা হয়েছে সব জেলার সুপারদের।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বান্দরবানের ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে র্যাব। সরাসরি জড়িত ছাড়াও যারা নেপথ্যে মদদ দিয়েছেন, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে র্যাবের গোয়েন্দারা।
তিনি আরও বলেন, আসছে ঈদেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে র্যাব। এ ব্যাপারে র্যাবের সব ব্যাটলিয়নকে বিশেষ নির্দেশানা দিয়েছে র্যাব সদর দফতর।