নিউজ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা যা করণীয় সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, জনগণের জান-মাল রক্ষা করা এবং জনগণের জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় যা যা করণীয় সেটা আপনাদের করতে হবে। এই সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক বা দুর্নীতির হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। সেই বিষয়ে অবশ্যই আপনাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে- সেটাই আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করব।
রবিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) নবনির্মিত বহুতলবিশিষ্ট প্রধান কার্যালয় ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। এনএসআই সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা বিষয় আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে যে আমরা জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছি এবং এসব ব্যাপারে আপনাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে, যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি চাই এনএসআই-এর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করবেন। আপনাদের কর্তব্য পালনের সময় যথাযথ শৃঙ্খলা বজায় রেখে আপনারা যদি আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, অবশ্যই বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নশীল দেশ, ইনশাল্লাহ ২০৪১ সালের মধ্যে এই বাংলাদেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার নেতৃত্বে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা এদেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু ’৭৫-এর পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বাংলাদেশকে বিচ্যুত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার আমরা জাতির পিতার সেই আদর্শকে ফিরিয়ে এনেছি। বাংলাদেশ আজকে সারা বিশ্বে একটা মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই মর্যাদাটা ধরে রাখা একান্তভাবে অপরিহার্য।
করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশের উন্নয়নে কিছুটা বাধার সৃষ্টি করলেও এই অবস্থা থেকেও বাংলাদেশ উত্তরণ ঘটাতে পারবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, টিকা দান কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে এবং দেশের মানুষ যাতে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে সেজন্য তাদের মধ্যে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাই, সকলকে একযোগে কাজ করার আমি আহ্বান জানাচ্ছি।
গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস। অনুষ্ঠানে এনএসআই প্রধান কার্যালয় প্রান্তে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টিএম জোবায়ের। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকও যুক্ত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত ২০০৯ সালে আমরা সরকার গঠন করার পর থেকে এনএসআই-এর গুরুত্ব বিবেচনায় এনে অনেক নতুন পদ সৃষ্টি এবং সংস্থার জনবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছি। একইভাবে আগের মঞ্জুরিকৃত পদকে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এনএসআই সদস্যদের কর্মস্পৃহা ও মনোবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের পরে বিভিন্ন পদে মোট এক হাজার ৬০১ জনকে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে, যা ইতোপূর্বে কখনই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার সরকার এ সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন পদে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টির জন্য সমন্বিত নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পদের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে ও বেতন স্কেল সমন্বয় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার এনএসআই-এর সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রেশন সুবিধা কার্যকর করেছে। যা আগে নির্দিষ্ট কিছু পদের কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত ছিল। এছাড়া এই সংস্থার জন্য পর্যাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে ঝুঁঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে আপনাদের জন্য ৩০ শতাংশ বিশেষ ভাতা মঞ্জুর করেছি। তিনি বলেন, জনবল ও কর্মপরিধি বৃদ্ধি পেলেও এনএসআই প্রধান কার্যালয়ের জন্য পর্যাপ্ত স্থান সঙ্কুলান ছিল না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাফতরিক কাজ এবং স্পর্শকাতর গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে তাঁর সরকার এর প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তদানুযায়ী তিনি ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে প্রধান কার্যালয় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় এনএসআই-এর নিজস্ব ভবন ছিল না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার প্রধান কার্যালয় ছাড়াও সকল বিভাগ ও জেলা এনএসআই অফিসের জন্য জমি বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে নিজস্ব জমিতে ৩টি বিভাগীয় কার্যালয় এবং ২০টি জেলা কার্যালয়ের ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে ২১টি জেলা কার্যালয় ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। অবশিষ্ট জেলাগুলোতে দ্রুত কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এতে কর্মদক্ষতা বাড়বে, জনগণের নিরাপত্তা বাড়বে এবং গোয়েন্দা কাজের মধ্যদিয়ে যেকোন তথ্য জোগাড় করাও সম্ভব হবে।
গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনায় প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষণের আধুনিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়টি বিবেচনায় এনে আমরা জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের জন্য ঢাকার ধামরাইয়ে ৯ দশমিক ৫৬ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছি। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের নতুন জনবল, যানবাহন ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অনুমোদন ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট-এর মাধ্যমে এনএসআই সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদেরও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যগণও এই প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন এবং তাঁদের সঙ্গে প্রশিক্ষণলব্ধ তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রধানমন্ত্রী এনএসআই সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্মকান্ডের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, ফলশ্রুতিতে দেশে অব্যাহত উন্নয়নের পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে। তিনি এ সময় করোনার প্রথম দফা আগ্রাসনের মতো দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলাতেও এনএসআই সদস্যদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নতুন করে দ্বিতীয় দফায় করোনা দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারী ব্যবস্থাপনায়ও আপনারা অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন। এখন যে অবস্থাটা হয়েছে সেখানেও দায়িত্ব পালন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অতিমারীর এই সঙ্কটকালেও আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দারিদ্র্যের হার কমছে এবং বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় সময়োপযোগী যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণেই অর্থনৈতিক উন্নতির এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুপারিশ লাভ করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এই অগ্রযাত্রা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ইতোমধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। সেই নির্দেশসা যাতে যথাযথভাবে সবাই পালন করে সেদিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। পাশাপাশি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও যেন সচল থাকে সে বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন। তবে, মানুষের জীবনটা আগে।
তিনি বলেন, জীবন যদি না বাঁচে তাহলে অর্থনীতিই বা কি আর রাজনীতিই বা কি। মানুষের জীবন আগে বাঁচাতে হবে। কাজেই স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিয়মনীতি মেনে চলে নিজেকে সুরক্ষিত করা এবং অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং সকলে যেন এটা সারাদেশে মানে সেটা নিশ্চিত করায় আপনারা দায়িত্ব পালন করবেন।
স্বাধীনতার পর জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এনএসআই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা ছিল মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর মার্শাল ল জারি করা হয় এবং একের পর এক সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় আসে এবং এই সংস্থাটির গুরুত্বও অনেকটা হারিয়ে যায়। যার ফলে সংস্থাটাকে অন্যভাবে ব্যবহার করা হতো। সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের দমন করা বা অন্য ধরনের কর্মকাণ্ডে। কিন্তু দেশের নিরাপত্তা বা জাতির নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই সংস্থার যে দায়িত্ব, সেটা অনেকটা সীমিত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, জাতির পিতা হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এনএসআইকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয় এবং পেশাগতভাবে এ সংস্থার সদস্যরা যেন দক্ষতা অর্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। কিন্তু যারা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তারা এখনও দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমি বলতে চাই, রাজনীতি আর সন্ত্রাসবাদ কখনও এক হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, জনগণের জানমাল রক্ষায় যা করা প্রয়োজন তাই করবেন। আমি এবং আমার সরকার সবসময় আপনাদের পাশে ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকব, ইনশাল্লাহ। আমরা চাই, ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। জাতির সেই লক্ষ্য পূরণে আপনাদের আরও বেশি কর্মতৎপর হতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ পরিণত করব।