নিজস্ব প্রতিবেদক:
- করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতেও ব্যাপক প্রস্তুতি
- ফের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা যায় কিনা ভেবে দেখার পরামর্শ
প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ পেয়ে উৎপাদনমুখী ভারি শিল্প খাতের ২ হাজার ৫৪৯টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এতে করোনার মধ্যেও কর্মসংস্থানের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে বেসরকারী খাত। শুরুতে গার্মেন্টস রফতানিতে চ্যালেঞ্জ বাড়লেও সেই সঙ্কট কেটে যায় ধীরে ধীরে। ৫০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক চার মাসের বেতন পাওয়ায় করোনাকালীন আর্থিক সঙ্কট দূর হয় পোশাক শিল্পের। কারখানা সচল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে আবেদনকারী সকল প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। ‘বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও করোনা মোকাবেলায় সরকারের প্রণোদনা কার্যক্রম’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত পুস্তিকায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ওই বইয়ে বলা হয়েছে, প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলানো এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ফের লকডাউনে চলে যাওয়ায় এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণ বাড়ছে দেশেও। এ অবস্থায় রফতানি, রেমিটেন্স ও আমদানি কার্যক্রমে আবার সঙ্কট দেখা দিতে পারে। অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে দ্বিতীয় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা যায় কি না সে বিষয়টিও ভেবে দেখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। করোনা থেকে জীবন বাঁচাতে চলতি বাজেটে শুধু টিকা কেনার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। টিকা আবিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সেই টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য টিকা কিনতে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ।
জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ভারি শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ২২ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা যা মোট প্যাকেজের প্রায় ৭১ শতাংশ। এছাড়া সচল রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য জুন ২০২০ এর বেতন ভাতা হিসেবে ২ হাজার ৫০০ এবং জুলাই ২০২০ এর বেতন ভাতা হিসেবে ২,৯০৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। অর্থাৎ মোট ২৮,৩৩৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। ৫১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এসব ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার ৯ শতাংশ, যার মধ্যে ঋণ গ্রহীতা ৪ দশমিক ৫ এবং বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার সুদ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। সরকার প্রদত্ত সুদ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্যাকেজের বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং বিভিন্ন তফসিলী ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে কোন ঋণখেলাপী এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি। এ প্যাকেজের আওতায় প্রদত্ত ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১ বছর। এছাড়া আর্থিক প্যাকেজের তারল্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ১৫ হাজার কোটি টাকার একটি আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে।
রফতানিমুখী গার্মেন্টস খাতে ঋণ বিতরণের ফলে তাদের অভিজ্ঞ কর্মীদের কর্ম থেকে ছাঁটাই করার দরকার হয়নি। একই সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে টিকে থাকতে সক্ষম হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক জনকণ্ঠকে বলেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের পোশাক খাত। প্রথম দফায় রফতানি অর্ডার কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। তবে প্রণোদনায় সেই সময় স্বস্তি ফিরে আসে দেশের প্রধান রফতানি খাতে। এখন আবার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। এ শিল্পের উৎপাদন, রফতানি ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে এ মুহূর্তে সরকারী নজরদারি প্রয়োজন। আশা করছি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায়ও সরকার গার্মেন্টস শিল্পের পাশে দাঁড়াবে।
প্রসঙ্গত, কোভিড-১৯ এর নেতিবাচক প্রভাবে শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এ প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশে এ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। প্রথম দফায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কর্মসূচী ঘোষণা করা হলেও পরবর্তীতে দুদফায় আরও ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে এর সীমা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন তফসিলী ব্যাংকের মাধ্যমে এ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ প্রদত্ত হয়েছে।
জানা গেছে, মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রতিঘাত মোকাবেলা করে বাংলাদেশ আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট বলে জানান অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। করোনায় জীবনহানি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ইতোমধ্যে টিকা কেনার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে করোনার প্রথম ধাপে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়। ওই সময় রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়া, শিল্প খাতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, রেমিটেন্স আহরণ হ্রাস, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা তৈরি এবং গার্মেন্টস পণ্য রফতানি কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এতে করে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। সরকার ঘোষিত ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে সমস্যাগুলো কেটে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী যাতে উপকৃত হয় সে লক্ষ্য নিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং সুসমন্বিতভাবে এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে সরকার। এতে করে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড সচল থাকায় দেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ’ শীর্ষক সিরিজ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে প্রথম মতবিনিময় সভাটি হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সভাটি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করা হবে।