নিউজ ডেস্ক:
দেশে অতিমারি বা মহামারিতে সংক্ষিপ্ত আকারে পাবলিক পরীক্ষা আয়োজন ও ফল প্রকাশ করতে পারবে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এ ক্ষমতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন আইন। ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০২৩’ নামে এ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জরুরি অবস্থা বা মহামারি অবস্থায় শিক্ষা বোর্ডগুলোকে সংক্ষিপ্ত আকারে পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ করতে স্থায়ীভাবে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই খসড়ায়। করোনাকালে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের জন্য এর আগে সংশ্লিষ্ট বিধি সংশোধন করা হয়েছিল। এবার আইনের মাধ্যমে এ সুযোগ স্থায়ী করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনের ১৭ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অন্যান্য ধারায় যা কিছুই থাকুক না কেন, অতিমারি, মহামারি, দৈবদুর্বিপাকের কারণে বা সরকার থেকে ঘোষিত সময়ে কোনো অনিবার্য পরিস্থিতিতে কোনো পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের আদেশে কোনো বছরের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নিয়ে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত পদ্ধতিতে মূল্যায়ন, ফলাফল প্রকাশ এবং সনদ দেওয়ার জন্য নির্দেশাবলি জারি করতে পারবে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান সমকালকে বলেন, করোনাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বেশ কিছু শিক্ষা নিতে হয়েছে। সে কারণে বিশেষ পরিস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নেওয়া বা পরীক্ষা ছাড়াই অন্যান্যভাবে মূল্যায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে আইনে। আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জানা গেছে, নতুন আইনে শিক্ষা বোর্ডগুলোর পরিচালনা পদ্ধতি পুরোপুরি পাল্টে ফেলা হচ্ছে। একই সঙ্গে দুর্নীতির রাশ টানার প্রচেষ্টাও রয়েছে এই আইনে। শিক্ষা বোর্ডের ‘সচিব’ পদ বদলে হচ্ছে ‘নির্বাহী পরিচালক’। বর্তমানে প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যানের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ সচিব। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে বর্তমান সচিবদের পদবি বদলে নির্বাহী পরিচালক হবে। এর বাইরে দুর্নীতির লাগাম টানতে বোর্ড কর্মচারীদের এক বোর্ড থেকে অন্য বোর্ডে বদলি করার বিধান রাখা হয়েছে। খসড়া আইনের ১২ ধারায় বলা হয়েছে, বোর্ডে নিয়োগকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবিধানমালায় বর্ণিত শর্তাবলি সাপেক্ষে জনস্বার্থে এক বোর্ড থেকে অন্য বোর্ডে বদলি করা যাবে। যদিও বদলি হতে রাজি নন কর্মচারীরা। নতুন এই ধারা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর অনেক কর্মচারী। তাদের দাবি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে তারা এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাকরিতে নিয়োগ পেয়েও শুধু বদলির ভোগান্তি এড়াতে তারা শিক্ষা বোর্ডের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। তাদের আপত্তি উপেক্ষা করে এটা করা হলে তারা পরিবার নিয়ে বিপদে পড়বেন।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কর্মচারী ফেডারেশন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার সভাপতি মো. জালাল উদ্দিন বলেন, সরকার চাইলে সবই করতে পারে। কিন্তু আমাদের নিয়োগপত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত ছিল না। এর আগেও আন্তঃবোর্ড বদলি চালুর অপচেষ্টা হয়েছিল। তবে সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। তিনি আরও বলেন, সবাই যার যার এলাকায় স্থায়ী হয়েছে। বদলির বিধান হলে প্রায় তিন হাজার পরিবার বিপদে পড়বে। বর্তমানে দেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। এর মাধ্য মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড তাদের পৃথক আইনে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের বাকি ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড পরিচালিত হচ্ছে ১৯৬১ সালের দি ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৬২ সালের দ্য রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুলস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী। বোর্ডগুলো হলো– ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ।
বোর্ড পরিচালনা করবে বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পর্ষদেরও সভাপতি হবেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডগুলো অথবা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড অথবা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন চেয়ারম্যান; সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অধীন এলাকায় অবস্থিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি সরকার মনোনীত; মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক মনোনীত একজন পরিচালক বা অধ্যাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা; সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অধীন এলাকায় অবস্থিত স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের মধ্য থেকে সরকার মনোনীত একজন অধ্যক্ষ; সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অধীন এলাকায় অবস্থিত সহশিক্ষা চালু রয়েছে এমন কলেজ বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর অধ্যক্ষদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন অধ্যক্ষ; বোর্ড এলাকায় অবস্থিত বিদেশি শিক্ষাক্রমে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের মধ্য থেকে সরকার মনোনীত একজন অধ্যক্ষ; বোর্ড যে জেলায় অবস্থিত সে জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি); সংশ্লিষ্ট বোর্ডের আওতাধীন মাধ্যমিক (বালক) বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের মধ্য থেকে সরকার মনোনীত একজন; মাধ্যমিক (বালিকা) বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন; সরকার মনোনীত দু’জন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি এবং সংশ্লিষ্ট বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক, যিনি পর্ষদের সদস্য সচিব হবেন।
আইনের খসড়া মতে, শিক্ষা বোর্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক সংশ্লেষ আছে এমন ব্যক্তিদের পরিচালনা পর্ষদে রাখা যাবে না। এতে বলা হয়েছে, দেশের সাধারণ শিক্ষা বোর্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে তিন বছর মেয়াদি ১২ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হবে। এর সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান। এই পর্ষদের অধীনে অর্থ কমিটি, নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটিসহ ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি হবে। বোর্ড-সংক্রান্ত বিষয়ে যাদের আর্থিক সংশ্লেষ আছে, তাদের পরিচালনা পর্ষদ ও এসব কমিটিতে রাখা যাবে না। পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্য প্রত্যক্ষভাবে বা কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে বোর্ডের সঙ্গে কোনো বিষয়ে চুক্তি করতে পারবেন না। কোনো শিক্ষা কোর্স বা পুস্তকে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে– এমন কোনো ব্যক্তিকে বোর্ড পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করা যাবে না। এমনকি বোর্ডের অনুমোদিত পুস্তক প্রকাশ, সংগ্রহ বা সরবরাহ করে– এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশীদার বা অন্য কোনো উপায়ে আর্থিক স্বার্থ থাকা ব্যক্তিকেও এই আইনের অধীনে গঠিত কোনো কমিটির সদস্য করা যাবে না। বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সমকালকে বলেন, দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন হচ্ছে। এতে মহামারিকালে বা জরুরি অবস্থায় শিক্ষা বোর্ডগুলোকে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে অস্থায়ীভাবে করা হলেও সেটি নতুন আইনে স্থায়ী করা হচ্ছে।