অঞ্জন রায়
সেই কালরাতে খুন না হলে আজ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তার ৬৭তম জন্মবার্ষিকী পালিত হওয়ার সময়ে তিনিও থাকতেন উপস্থিত। তবে এটিও নিশ্চিত, করোনাকালে তিনি সামান্য কোনও আয়োজনও করতে দিতেন না এবারের জন্মদিনের। কিন্তু তার সেই বেঁচে থাকাটাই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষের কাছে ছিল হুমকি, যে কারণে ১৫ আগস্ট রাতে তিনিও ছিলেন বুলেটের নিশানা। হ্যাঁ, ২৮ এপ্রিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের জন্মবার্ষিকী। শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই অকুতোভয় মানুষটিকে, যে মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গৃহবন্দি হন। কিন্তু সেই অবস্থা সব পাহারার চোখ এড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কমিশন প্রাপ্ত কৃতী অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ভাষা আন্দোলনের দুই বছর পরে ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল জন্ম নিয়েছিলেন শেখ জামাল। জনকের জন্মভূমির টুঙ্গিপাড়াতেই। পিতা একটি মানচিত্র বুকে ধারণ করে লড়ছেন—কখনও কারাগার, কখনও রাজপথ। চষে বেড়াচ্ছেন তার সোনার বাংলার মাঠ প্রান্তর। মজুর কৃষক থেকে কারখানার শ্রমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সবাই যখন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে একত্রিত হচ্ছেন, সেই সময়েই বেড়ে উঠছেন শেখ জামাল। একদিক দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন বাঙালির স্বাধীনতার পথযাত্রার হাত ধরে, ঠিক যেমন এই জনপদের মানুষ প্রস্তুত হয়ে উঠছিলেন তাদের নিজস্ব পরিচয় সম্বলিত স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য, তেমনই শেখ জামাল বড় হয়ে উঠছিলেন আন্দোলন সংগ্রামর উত্তাপের কেন্দ্রে তার জনক ও বাঙালি জাতির জনক ও বঙ্গমাতার স্নেহে।
শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছিলেন। পছন্দ ছিল তার সুর, সে কারণেই গিটার শিখতে ভর্তিও হয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে, ক্রিকেটার হিসেবেও ছিল তার সুনাম। ছিলেন রাজনীতিতে আগ্রহী ও সচেতন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৫ আগস্ট ধানমণ্ডির তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে রাখা আর পাকিস্তানি বাহিনীর তীক্ষ্ণ নজর রাখা বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ জামাল। ভারতে পৌঁছে আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে তিনি উত্তর প্রদেশের কালশীতে মুজিব বাহিনীর ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
৯ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শেখ জামাল যে ঘরে থাকতেন, সেখানে রাইফেল কাঁধে তার মুক্তিযুদ্ধকালীন ছবির দৃঢ়তা আর সাহসে ভরা একজোড়া চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মানুষটির ভেতরের সাহস আর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল সম্মিলন। যুদ্ধশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে সেই যুদ্ধের পোশাকেই শেখ জামাল ঢাকায় ফিরে আসেন স্বাধীনতার দু’দিন পরে ১৮ ডিসেম্বর। ভাইকে কাছে পেয়ে বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলের পরম শান্তি, শান্তি বঙ্গমাতার চোখেও। তবে তখনও উদ্বেগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্য। বাড়ি ফিরে সেদিন বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায় যোগ দেন শেখ জামাল।
শেখ জামাল পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আশীর্বাদ নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ করে রেখেছিলেন সেখানে সবাইকে। সৈনিক থেকে সিনিয়র অফিসার, সবারই হয়ে উঠেছিলেন নয়নমণি। কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা আর অহংকারহীন জীবনযাপনে সবাইকে আপন করে নিতে তার তুলনা মেলানো প্রায় অসম্ভব। আর সেই কারণেই তিনি তার পরিচিতদের কাছে হয়ে আছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণের সময়। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রায় প্রতিটি বড় অবকাঠামো তছনছ করে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পরাজয় নিশ্চিত বোঝার পরেই তারা চালিয়েছিল দুই ধরনের ধ্বংস—একদিকে তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে। একই সঙ্গে তারা দেশটিতে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, যাতে দেশটির অর্থনীতির চাকা ভেঙে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। সময়টা খুবই কম, কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বনেতাদের একজন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশটিতে একদিকে যখন নির্মাণপর্ব চলছে, তখনই আরেকদিকে চলছে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা।
সব সময় না হলেও কখনও কখনও ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়, আর সেই কারণে ইতিহাসের গায়ে তৈরি হয় রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন। তেমনই এক দুর্ভাগ্য আমাদের ইতিহাসেও রয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হলো বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শিশু রাসেলসহ কেউই সেদিন ঘাতকের বুলেট থেকে রক্ষা পায়নি। পরিবারের সবার সঙ্গে সেই কালরাতে শহীদ হলেন শেখ জামাল। বাঙালির প্রগাঢ় বেদনার মাঝেও সেই রাতে একটাই সান্ত্বনা—বাংলাদেশের বাইরে থাকাতে ঘাতকের বুলেট স্পর্শ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাকে। পারেনি বলেই বাংলাদেশ অনেক বেপথে ঘুরেও আজ আবার ধাবমান বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার দিকে। দেশটির হাল ধরে আছেন জাতির জনকের সন্তান শেখ হাসিনা।
দীর্ঘ নয় শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের জীবন। ২৮ এপ্রিল ১৯৫৪ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। জীবন যখন নির্মাণের ধাপগুলো স্পর্শ করছে, তখনই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। শহীদ শেখ জামাল আছেন বনানী কবরস্থানে, তার পাশেই আছেন স্ত্রী রোজী জামাল। তার হাতের মেহেদির রং আর রক্তে একাকার হয়ে যিনি শহীদ হয়েছিলেন সেই একই রাতে, এক সঙ্গে। ৬৭তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাই শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের প্রতি। আর একই সঙ্গে আরও একবার ঘৃণা ১৫ আগস্টের খুনি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের জন্য।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]