রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪
নীড় পাতা / ফিচার / শারদীয় উৎসবে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা

শারদীয় উৎসবে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা

গোপাল অধিকারী,
পূজা মানেই আনন্দ, পূজা মানেই উৎসব। ধর্ম আলাদা হলেও উৎসব আর আনন্দ সবার। ঈদের সময় ধর্মভেদে সবাই যেমন আনন্দ উপভোগ করে, ঠিক তেমনি পূজার ক্ষেত্রেও নিজ নিজ ধর্মকে পাশে রেখে একসঙ্গে সময় কাটায়, আনন্দের পসরা সাজায় মানুষ। আর এটি যেমন বাংলাদেশের জন্য সত্য, তেমনি সত্য পৃথিবীর অন্য সব দেশের ক্ষেত্রেও।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় চিরচরিত রীতি অনুযায়ীই হয়ে থাকে পূজা। ইতিহাসে জানা যায়, বাঙালির আধুনিক দুর্গাপূজার সূচনা রাজশাহীর তাহিরপুরে। রাজা কংশনারায়ণের উদ্যোগে ১৫৮০ সালে যে পূজার সূচনা এই বঙ্গে হয়, তা ছড়িয়ে পড়েছে এখন সকল মহাদেশে। মহালয়ায় দেবীপক্ষের শুরু। তারপর পঞ্চমীতে দেবীকে মন্দিরে স্থাপন। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন থেকে দশমীতে বিসর্জন পর্যন্ত চলে পূজার রকমারি আয়োজন। পূজা ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর মেলা। ব্যতিক্রম থাকে কোন কোন জায়গাতে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গস্থ মিশনসমূহে মহাঅষ্টমী তিথিতে হয়ে থাকে কুমারী পূজা। এদিন কুমারীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কুমারীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা দিয়েছিলেন বলে এ রীতির প্রচলন হয়।

প্রচলন অনুযায়ী পূজা হলেও এবছর পূজাটি হবে ব্যতিক্রম। করোনা ভাইরাসের কারণে লোকসমাগম, স্বাস্থ্যবিধিসহ নানারকম বিধি-নিষেধ নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে শারদীয় উৎসবটি। আমার কাছে এবছরের পূজাটি সর্ম্পূণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করি। কথায় বলে, হিন্দুধর্ম চলে আচারে। করোনার কারণে বার বার হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এগুলো হবে উপাসনার নিয়মানুবর্তিতা। তবে এবার উৎসব হবে আনন্দ হবে না এমনটাই অভিমত অনেকের। স্মরণকালের প্রথম এমন পূজায় হয়ত আমরা অনেকেই হতবাক ও বিচলিত। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে না, হবে না তেমন জমায়েত, করা যাবে না দশমী শোভাযাত্রা। করোনায় এগুলো মানতে পারলেও সরকাররের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে পূজা কমানো বক্তব্যের আমি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি। কারণ কোন কিছু সৃষ্টি করে তা রক্ষা করাই ধর্ম। সৃষ্টিই না করলে ধর্ম কেমন হবে?

প্রকৃতি সৃষ্ট করোনা নিয়ে আমি খুব একটা বিচলিত না কারণ, করোনা নেই এমন ধারনায় বাড়ির বাইরে গেলে মনে হয়। কিন্তু আমার কাছে তার থেকে বিচলিত মনে হয় বিভিন্নস্থানে পূজার অবকাঠামো। মা একই ও অভিন্ন। কিন্তু বিভিন্ন স্থানের অবকাঠামো পূজাকে করে সৌন্দর্য বর্ধিত। কিন্তু যাদের সাধ আছে সাধ্য নেই তাদের জন্য পূজা কি নিরানন্দ? পূজা নিয়ে অনেক কথায় রয়েছে। যেমন বর্তমানে শারদীয় উৎসবে তিনদিনের সরকারি ছুটির দাবিতে আন্দোলন চলছে। পূর্বে এই দাবিতে জনসম্পৃক্ততা কম থাকলেও বর্তমানে শারদীয় উৎসবে তিনদিন ছুটির দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করছে হিন্দু মহাজোটসহ বিভিন্ন সংগঠন। সারাদেশে একযোগে মানববন্ধন করেছে সংগঠনটি। ছুটিটা শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের, না সকলের হবে এটা নিয়ে আমি অবশ্য পরিষ্কার নয়। যদি সকলের জন্য হয় তবে আমার বিশ্বাস দাবির বিপক্ষে নাই কোন পক্ষই। কারণ ছুটি কে না চাই? ছুটি সকলে পেলে কে না ভোগ করবে? আবার রাষ্ট্রের কথা যদি চিন্তা করা যায় তাহলে কিন্তু সকলের ছুটি জোর দাবি করাও যায় না। কারণ রাষ্ট্রের একদিনের ছুটিতে অনেক আয়-ব্যয় তথা কর্মকান্ড জড়িত।

তবে শুধুমাত্র সনাতনধর্মাবলম্বীদের যদি ছুটি দেওয়া যায় তাহলে রাষ্ট্রেরও ক্ষতি হলো না উৎসবটিও পালিত হলো। এটা মনে হয় সরকার ভাবতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৮ (১) নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ বা সরকারি নীতি নির্ধারক মহলের কেউ নয় তাই দাবিটা কতটা যৌক্তিত তা নিয়ে বলতে চাই না। তবে আমার কাছে মনে হয় শারদীয় উৎসবে সরকারি পৃষ্টপোষকতা বৃদ্ধি করা যায় কি না এই বিষয়ে একটু ভাবা দরকার। যেহেতু সনাতন সম্প্রদায়ের একটি মাত্র বড় ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসব যেন সকলে আনন্দপূর্ণভাবে পালন করে সরকারের সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

বছরের কোন দিন কেউ না গেলেও শারদীয় উৎসবে বিভিন্ন স্থানের জনগোষ্ঠী বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করে সেখানে দেখা যায় অনেক মন্দিরের সীমানা বা স্থায়ী মন্দির নেই। ফলে আয়োজক কমিটি যেমন নিরাপত্তাহীনতায় থাকে ঠিক তেমনি অনিশ্চয়তায় দায়িত্বপালন করে নিরাপত্তা দায়িত্ব থাকা সকলে। এমন অনেক মন্দির কমিটি আছে যারা কোনরকমভাবে আলো জ্বালিয়ে পূজা করছেন। বিশেষ করে দলিত জনগোষ্ঠীরা এই উৎসবটি পালন করে একেবারেই নিভৃতভাবে। পূজা আসলেই তাদের মনে আনন্দের চেয়ে মনে হয় বেদনা বাড়ে। একটি বছর পর দেবী আসবে। পূজা করবে কি না, করলে কেমন করে করবে এই নিয়ে যেন চলে তুমুল চিন্তা-ভাবনা। সরকার বিভিন্নভাবেই দলিতদের উন্নয়নে কাজ করছে। কাজ করছে সকল ধর্মের অনুষ্ঠান উৎসবমুখর ও প্রাণের ছোয়ায় রাঙিয়ে দিতে।

সরকারের সেই ইতিবাচক কর্মকান্ডের সাথে শারদীয় উৎসবে যদি প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন মনে হয় মন্দ হয় না। আমরা জানি সরকার এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি বরাদ্দ দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই বরাদ্দ মূর্তি বানানোর ব্যয়ও বহন করে না। তাই আমি মনে করি সারাদেশে কতটি মন্দির রয়েছে যাদের অর্থবল নেই তাদের জরিপ করুন। জরিপ করে ব্যবস্থা নিন আশা রাখি সেটা অসাম্প্রদায়িক সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। পত্রিকা মারফত জেনেছি, বাগেরহাট জেলার হাকিমপুর শিকদার বাড়িতে করা হয় জমকালো চোখ ধাঁধানো আয়োজন।

২০১৭ সালে সেখানে ছিল ৬৫১টি প্রতিমা। ২০১৮ সালে সেখানে ছিল ৭০১টি প্রতিমা । আর ২০১৯ সালে এই মন্ডপে ৮০১টি প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিমার সংখ্যার দিক দিয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পূজা মন্ডপ বলে দাবি করেন পূজার আয়োজক ব্যবসায়ী লিটন শিকদার এবং বাগেরহাট পূঁজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অমিত রায়। বিশ্বের বড় পূজা মন্ডপ বাংলাদেশে এটা আমাদের গর্ব। ঠিক একই ভাবে গর্বের জায়গা হতে পারে অসহায় মন্দিরে সরকারের শারদীয় উৎসবের প্রণোদনা। এই থেকেই বোঝা যায় সৌন্দর্য বা অবকাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে বেড়েছে প্রতিমাশিল্পীদের মজুরীও। সেখান থেকে পূজাকে কেন্দ্র করে সরকারি সহযোগীতা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

ভাবনায় রয়েছে নিরাপত্তা নিয়েও। পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে ২০১৯ সালে ১৩ মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে যা ২০১৮ সালে হয়েছিল ১৮টি মন্দিরে। এই বছরে যেন এমন কোন ঘটনার পূনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে। সম্প্রতিকালে বেড়েছে ধর্ষণ। যে কারণে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে যেতে চিন্তিত হবেন। যদিও আমি মনে করি চিন্তার কোন বিষয় নেই বা আমি বিচলিত নয় কারণ আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকার বেশি চিন্তিত। সরকার কখনই চাইবে না এই সময়ে কোন অপরাধ সংগঠিত হয়ে কেউ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করুক। তবে সরকার বিরোধিরা এই ইস্যুটিকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে। তাই সরকারকে বলব অবশ্যই নিরাপত্তা জোরদার করতে কৌশলী হবেন। অপরাধের ধরন জেনে ব্যবস্থা নিবেন। বিশেষ করে মন্দিরে মন্দিরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তাবাহিনীকে আধুনিক ও কৌশলী করবেন। জনসমাগম ও নির্জন দুই স্থানগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করবেন। কাজে লাগাতে হবে বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষাপট, কারণ ও প্রতিরোধ। আর অপরাধীদের ক্ষুদ্রেবার্তা দিতে চাই বর্তমানে কোন অপরাধই চোখের আড়াল করার উপায় নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহূর্তেই তা ভাইরাল হচ্ছে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। তাই অপরাধের দিন শেষ।
বর্তমান সরকার সকল ধর্মের ব্যাপারে খুবই সচেতন বা সদয়শীল।

বর্তমান সরকার অসাম্প্রদায়িক সরকার। সরকার অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কঠোর তৎপর। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি নিজেই অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেন ধর্ম যার যার ,উৎসব সবার। তবে সকল মন্দির যদি আর্থিক সঙ্কুলতা কাটিয়ে নিরাপত্তায় পূজা উদযাপন করতে পারে তাহলে বাক্যটি যথার্থ হবে। আমি মনে করি সরকারের অবশ্যই এ বিষয় নিয়ে বিবেচনা করা উচিত। রাষ্ট্র, উৎসব ও বাস্তবতা উভয়দিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই। সঠিক সিদ্ধান্তই “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” কথাটি শতভাগ সফল করতে পারবে।

আরও দেখুন

অতিরিক্ত ভালোবাসা ঠিক নয়

নজরুল ইসলাম তোফা: আমরা জীবনে চলার পথে বহু মানুষকে “ভালোবাসা” দিয়ে দিয়ে থাকি। হয়তো আমরা …