নিউজ ডেস্কঃ
‘কিচ্ছু নাই, সব পুড়ে শেষ।’ বস্তির ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারেনি শাকিলের মা-বাবা। গত ৬ বছর ধরে একটু একটু করে গোছানো সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে চোখের সামনে। এখন কী খাবে, কোথায় থাকবে, কী পরবে-এসব নিয়েই অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা। বিলাপ করে এসব কথাগুলোই বলছিলেন শাকিলের মা বানেসা বেগম। দুই ছেলে এক মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্ন নিয়ে বনানী টিঅ্যান্ডটি মাঠসংলগ্ন বেদেরঘাট বস্তিতে ৬ বছর ধরে বসবাস করছিলেন তিনি।
শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত ৩টার দিকে বনানীর টিঅ্যান্ডটি মাঠসংলগ্ন বেদেরঘাট বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাদের স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে পোড়া বস্তিতে গিয়ে দেখা গেল, বানাসা বেগম খোলা আকাশের নিচে বসে পুড়ে ছাই হওয়া ঘরের জিনিসগুলোতেই হাতড়ে অবশিষ্ট কিছু পাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশেই আছে ৯ বছর বয়সী ছেলে শাকিল। সেও পুরে ছাই হওয়া জিনিসগুলোর মাঝে কিছু খুঁজছে। আগুনে তার স্কুলের জামা-কাপড়, বই, ব্যাগ-সবই পুড়ে গেছে।
এমন সময় শাকিলের দুই সহপাঠী (তারা থাকে পাশের কড়াইল বস্তিতে) স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম পরে এসেছে শাকিলকে স্কুল নিয়ে যেতে। ‘চল, শাকিল স্কুলে যাই’। উত্তর ছোট্ট শাকিল বলে, ‘নারে, আমার যাওয়া হবে না, তোরা যা, আমাদের সব পুড়ে গেছে। আমার বই, খাতা, ব্যাগ কিছুই নেই। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নতুন করে এসব কেনা হলে তারপর স্কুলে যাব। তোরা যা…।’
টিএনটি বালক উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে শাকিল। তার বড় ভাইয়ের নাম জামিল হোসেন (১০)। বড় বোনসহ সবাই বিভিন্ন স্কুলে পড়ে। আগুনে সব কিছু পুড়ে যাওয়ার কারণে তারা সবাই আপাতত খোলা আকাশের নিচেই থাকছে।
কথা হয় শাকিলের মা বানেসার বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একটা কিছুই ঘর থেকে বের করতে পারিনি। ৬ বছর ধরে এই বস্তিতে থেকে ধীরে ধীরে সংসারটা গুছাচ্ছিলাম। কিন্তু আগুনে সব শেষ করে দিল। ওদের বাবা ভাঙারির ব্যবসা করে। আমাদের যা কিছু ছিল সব শেষ। এখন তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে কী খাব, কী করব- সব কিছুই এখন অনিশ্চিত।’
একটি বিভীষিকাময় রাত। প্রায় দুই ঘণ্টার আগুনে বানেসার মতো অসংখ্য বস্তিবাসীর সব স্বপ্ন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন তারা নিঃস্ব। খোলা আকাশের নিচে রাতদিন কাটছে তাদের।
পরিবার নিয়ে জীবন নির্বাহের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে কেঁদে বিলাপ করছেন কেউ কেউ। কেউবা আবার বস্তি সংলগ্ন দোকানগুলোর পুড়ে যাওয়া টিন বের করছেন। যাদের ঘর পুড়েছে তারা সবাই খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন। কেউ কেউ পলিথিন টাঙিয়ে ঘরের মতো করে সেখানেই শুয়ে আছেন। কেউ পুড়ে যাওয়া সবকিছু পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন।
বস্তিবাসীর অভিযোগ, আগুন লেগেছিল মূলত পাশের গোডাউন বস্তি থেকে। সেখান থেকে বাতাসের কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের বেদেরঘাট বস্তিতে। আগুনে দুই বস্তি মিলে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। আগুনে গৃহহারা বস্তির মানুষগুলো অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন টিঅ্যান্ডটি কলোনির মাঠে খোলা আকাশের নিচে।
পুড়ে যাওয়া এই বস্তিতে থাকতেন এরশাদ আলী নামের একজন মধ্যবয়সী রিকশাচালক। তিনি বলেন, ‘বউ বাচ্চাসহ আমারা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ আগুন, আগুন চিকিৎকারে দৌড়ে বের হই। কিন্তু ঘর থেকে কিচ্ছু বের করতে পারিনি। চোখের সামনেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখন আর আমাদের সম্বল বলে কিচ্ছু নেই। আগুনের কারণে রাতারাতি আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আগুনে পোড়া ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির পরিবারগুলোর থাকা-খাওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হবে।’
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বনানীর টিঅ্যান্ডটি মাঠসংলগ্ন বেদেরঘাট বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট প্রায় ২ ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।