নিউজ ডেস্ক:
দেশে সম্প্রতি শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত ও ঋণ দুই-ই বাড়ছে। অন্য সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে আমানত বেশি বাড়লে ঋণ বাড়ত কম হারে। ঋণের বড় অংশই শহরকেন্দ্রিক। যে কারণে শহরে ঋণ বাড়ত বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার বাইরে যত ব্যাংক আছে, ব্যাংকের দৃষ্টিতে সেগুলো গ্রামীণ ব্যাংক।
অবশ্য সরকার করোনার ক্ষতি মোকাবিলা এবং বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গ্রামে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। যে কারণে এখন গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই-এই ছয় মাসে গ্রামে আমানত প্রবাহ বেড়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং শহরে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শহরের তুলনায় গ্রামে আমানত বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ে গ্রামে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। একই সময়ে শহরে বেড়েছে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ওই সময়েও শহরের চেয়ে গ্রামে আমানত বেশি বাড়ে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একই সময়ে শহরে বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ওই সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে গ্রামে ঋণ বেড়েছিল ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং শহরে ২ দশমিক ০৭ শতাংশ। ওই সময়ে গ্রামের চেয়ে শহরে ঋণপ্রবাহ বেশি বৃদ্ধি পায়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, ‘এটি আশার কথা যে গ্রামে ঋণপ্রবাহ বেশি বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গ্রামকে অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় শহর থেকে। যে কারণে শহরে ঋণ ও আমানত দুটোই বেশি। কিন্তু কৃষি বা শিল্প উৎপাদন সবই গ্রামকেন্দ্রিক। কেননা শিল্পের বেশির ভাগ কারখানাই গ্রামে। কৃষি উৎপাদন তো পুরোটাই গ্রামভিত্তিক।’
তিনি আরও বলেন, আগে গ্রামে আমানত বেড়েছে; কিন্তু ঋণ বাড়েনি। ফলে গ্রামের টাকা শহরে চলে এসেছে। এখন গ্রামে আমানত বাড়ার পাশাপাশি ঋণও বাড়তে শুরু করায় গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়বে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করতে সহায়ক হবে। তবে এই গতিতে ছেদ পড়লে এর প্রকৃত সুফল মিলবে না।
সূত্র জানায়, করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাড়নো যাচ্ছিল না। কারণ গ্রামে ঋণের চাহিদা কম। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। খাদ্য আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এজন্য কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে কম সুদে ঋণ দিতে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। তৈল বীজ উৎপাদনে গঠন করা হয়েছে আরও ৫ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল। এছাড়া চলতি অর্থবছরে ৩১ হাজার কোটি টাকার পল্লি ও কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আরও কিছু তহবিলের আওতায় গ্রামে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হচ্ছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট আমানত ও ঋণের সিংহভাই ঢাকা বিভাগে। এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান। মোট আমানতের ৭৯ শতাংশই শহরের। গ্রামের আমানত ২১ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬২, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১, খুলনা বিভাগে ৪ দশমিক ২২, রাজশাহী বিভাগে ৪, বরিশাল বিভাগে ১ দশমিক ৮৭, সিলেট বিভাগে ৩ দশমিক ৭৬ এবং রংপুর বিভাগে ২ শতাংশ আমানত রয়েছে। সবচেয়ে কম আমানত ময়মনসিংহ বিভাগে মাত্র দেড় শতাংশ।
মোট ঋণের ৮৯ শতাংশই শহর এলাকায় বিতরণ করা হয়। গ্রামে মাত্র ১১ শতাংশ। ঋণের ৬৮ শতাংশই ঢাকা বিভাগে। চট্টগ্রামে সাড়ে ১৮, খুলনায় ৩ দশমিক ৮১, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৭১, সিলেটে ১ দশমিক ১৪, রংপুরে ২ দশমিক ৩৮ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম ঋণ বিতরণ করা হয় বরিশাল বিভাগে ১ দশমিক ১২ শতাংশ।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংকের সেবা গ্রামেও বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। শাখার প্রায় অর্ধেক এখন গ্রামে। গ্রামীণ শাখাগুলো থেকে আগে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা কম থাকলেও এখন বেড়েছে। সারা দেশে ব্যাংকগুলোর মোট শাখা রয়েছে ১০ হাজার ৭৯৩টি। এর মধ্যে শহরে শাখা ৫ হাজার ৫৫৪টি এবং গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ২৩৯টি। মোট শাখার সাড়ে ৫১ শতাংশ শহরে এবং গ্রামে সাড়ে ৪৮ শতাংশ।