নিজস্ব প্রতিবেদক, লালপুর:
১৯৭১ সালে ৫ মে নাটোরের লালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে পাক হানাদার বাহিনীর বুলেটে শহীদ ৪১ জন মুক্তিকামী বাঙ্গালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী আজও মুক্তিযোদ্ধা হিসিবে স্বীকৃতি মেলেনি। তবে এই ৪১ জন ছাড়া মিলের তৎকালীন প্রশাসক শহীদ লেঃ আনোয়ারুল আজিম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরুস্কার পেয়েছেন তিনি বলে জানা গেছে। অন্য শহীদ ৪১ জন মুক্তিকামী বাঙ্গালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় হতাশার মধ্য দিন কাটাচ্ছে তাদের পরিবারের সদস্যরা।
জানা যায়, ১৯৭১ সালে ৩১ মার্চ ভোর ৬ টার দিকে মশারি ও শাড়ী পড়া অবস্থা পালিয়ে যাওয়ার সময় মেজর রাজা আসলাম খান, হায়দার খান, সুবেদার গুলবাহার খান ও তাদের সহকারী আরো ৪ জন সিপাহীকে মুক্তিকামী জনতা সহ নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের তৎকালীন নিরাপত্তা পরিদর্শক হামিদুল হক চৌধুরী (বাবু) তাদেরকে ধরে মিলে নিয়ে আসে। পরে মিলের তৎকালীন প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিমের বাংলোতে তাদের কে কয়েক ঘন্টা আটকে রাখা হয়। ওই দিন ৩১ মার্চ মিলের জিপ গাড়ীতে করে মেজর রাজা আসলাম খান, হায়দার খান, সুবেদার গুলবাহার খান সহ তাদের সহকারী আরো ৪ জন সিপাহীকে লালপুর শ্রী সুন্দরী স্কুল মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানে তাদেরকে হাজারো জনতার মধ্যে মিলের তৎকালীন নিরাপত্তা পরিদর্শক হামিদুল হক চৌধুরী (বাবু) গুলি করে হত্যা করে বলে এই তথ্যা পাওয়া গেছে।
তাদের গুলি করে হত্যা করার বিষয়টির খবর চারে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে হানাদার বাহিনী প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে ৫ মে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে অতকির্ত হামলা চালায় এবং মিলের সব গুলো প্রবেশ পথের দরজা বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী সদস্যরা। পরে মিলের তৎকালীন প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিম সহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে গোপাল পুকুরের পাড়ের (বর্তমান শহীদ সাগর) সামনে তাদেরকে শারি করে চোখ বেধে দাঁড় করানো হয়।
এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা অবাঙ্গালী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছেড়ে দেয়। এ সময় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মিলের তৎকালীন প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিমকে ধমক দিয়ে বলেন, মেজর রাজা আসলাম সহ তাঁর সহকারীদের কেন গুলি করে মারা হলো? সেই সময় প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিম বলে, আমি জানিনা। হানাদার বাহিনীর সদস্যরা সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হত্যার হুমকি দিয়ে আবার বলে তুমি না বললে সবাই কে গুলি করে হত্যা করবো। এ সময় আনোয়ারুল আজিম বলেন, তোমারা আমাকে গুলি করে হত্যা কর। মিলের কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হত্যা করোনা। পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তাঁর কথা শুনেনি। পরে ওই পুকুর পাড়ে মিলের তৎকালীন প্রশাসক আনোয়ারুল আজিম সহ মুক্তিকামী ৪১ জন বাঙ্গালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে বলে জানা গেছে।
মিলের তৎকালীন প্রশাসক শহীদ লেঃ আনোয়ারুল আজিম সহ ৪২ শহীদের স্মরণে স্বাধীনতার পরে ওই পুকুর টি শহীদ সাগর নামকরণ করা হয়েছে ও সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে। এছাড়া শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আর হানাদার বাহিনির বুলেটের আঘাত এর চিহ্ন পুকুরের সিঁড়ীতে কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে। এছাড়া শহীদ সাগরে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভে মিলের তৎকালীন প্রশাসক শহীদ লেঃ আনোয়ারুল আজিম সহ মুক্তিকামী ৪২ জন বাঙ্গালী শহীদ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামের তালিকা স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে শহীদ লেঃ আনোয়ারুল আজিম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং স্বাধীনতা পুরুস্কার পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
মুক্তিকামী বাঙ্গালি মিলের ৪১জন শহীদ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আগামী বিজয় দিবসের আগেই স্বীকৃতির জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান শহীদের শুভাকাঙ্খীরা।
এ বিষয়ে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের তৎকালীন প্রশাসক শহীদ লেঃ আনোয়ারুল আজিম এর ছেলে ডাঃ আনোয়ারুল ইকবাল মিতু বলেন, ইতি মধ্যে আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং আমার বাবা নামে আজিমনগর নামকরণ করে লালপুরের গোপালপুর রেলওয়ে একটি স্টেশন করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে আমার বাবার নামে ডাক টিকেট বের করেছেন এবং আমার বাবাকে ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরুস্কার দিয়েছেন। ৪১ জন শহীদকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়ে যা সহযোগীতা করার প্রয়োজন তাই করবেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে মিলের তৎকালীন নিরাপত্তা পরির্দশক বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক চৌধুরীর ছেলে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বুলেটের আঘাতে মিলের যে সকল মুক্তিকামী বাঙ্গালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী শহীদ হয়েছেন, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে মিলের শহীদ পরিবারের সদস্য ফোরাম ৭১’এর সভাপতি ফরাদুজ্জামান রুবেল বলেন, মিলের তৎকালীন প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিম ও আমার বাবা সহ ৪২ জন মুক্তিকামী বাঙ্গালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী। এই ৪২ জনের মধ্যে শুধু মাত্র মিলের তৎকালীন প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিম মহোদয়কে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শহীদ ৪১ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার পক্ষের সরকার। তাঁর বাবা সহ ৪১ জন শহীদকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের সু-ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার(দায়িত্বপ্রাপ্ত)শাম্মী আক্তার বলেন, সুগার মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর বুলেটে যারা শহীদ হয়েছেন। সে সকল শহীদগণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পায়নি। এবিষয়টি উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।
এ বিষয়ে নাটোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ সরকার বলেন, মিলের তৎকালীন প্রশাসক শহীদ লেঃ আনোয়ারুল আজিমকে সরকার যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাঁকি ৪১ জন শহীদকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সরকারের সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এবিষয়ে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়ন কবীর বলেন, শহীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে মিলের প্রাক্তন কর্মকর্তা ও নাটোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর সাবেক কমন্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ সরকার যে মতামত দেবেন। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান তিনি।
এবিষয়ে নাটোর-১লালপুর-বাগাতিপাড়া আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।