রেজাউল করিম খান
বেনারসি শাড়ি ছাড়া কি বিয়ে হয়? ধনী-গরিব নির্বিশেষে, সব মেয়েরই বিয়ের আগে চায় অন্তত, একটি বেনারসি শাড়ি। স্বোপার্জিত শাকান্নের জন্য কাকডাকা ভোরে ঘুম ছেড়ে যে মেয়েটি কাজের খোঁজে ঘর ছাড়ে, সেও তার বিয়ের আগে চায় একটি বেনারসি। আবার সবচেয়ে ব্যয়বহুল মুম্বাই সিনেমা দেবদাসে ঢাকার বেনারসি পরে অভিনয় করেছেন মাধুরি দীক্ষিত ও ঐশ্বরিয়া রাই। তবে আমরা আজ গরিব ও নিম্মধ্যবিত্তদের জন্য বেনারসি তৈরির কাহিনী শোনাবো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, লালপুরের সেই বেনারসি পল্লীর শাড়ি তৈরির কারখানা ক্রমেই ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। সেই গল্প লেখার পূর্বে লেখকের ব্যক্তিগত কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।
আমার প্রতিবেশী গোলাম ইখতিয়ার তাজু, পল্লী বিদ্যুতের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি সৌখিন স্থির চিত্রশিল্পী। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে কয়েকটি দেশি ও বিদেশি পুরস্কার। ১৯৮১ সালে আমি যখন দৈনিক ইত্তেফাকে খবর লেখা শুরু করি, তখন থেকেই তাঁর সাথে আমার খবর ও ছবি নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। কিন্তু দূরে চাকরির ব্যস্ততায় নিয়মিত সাক্ষাৎ হয়নি। এছাড়া তখন সংবাদপত্র ছাপা হতো সাদা-কালোয়। ‘মফস্বলের’ খবর ও ছবিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না।
নব্বইয়ের দশকে সংবাদদাতা হিসেবে কিছুটা পরিপক্ক হই আর সেই সাথে গুরুত্ব পেতে থাকে ছবিও। শুরু হয় তাজুর ছবির সাথে আমার খবর, ফিচার ও প্রতিবেদন লেখা, অথবা আমার খবরের প্রয়োজনে তাঁর ছবি তোলা। ২০০৪ সালে ইত্তেফাকের রাজশাহী অফিসের প্রধান হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় নাটোরের রাজাপুর, চাপিলাসহ চলনবিলের বিস্তীর্ণ জলাভ‚মি, লালপুরের বিলমাড়িয়, পদ্মার ভাঙন, প্রত্যন্ত চরাঞ্চল, গোদাগড়ীর আদিবাসী পল্লী-সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি দেখা, জানা আর সংগ্রহের আকাঙ্খায়।
২০০৭ সালে আমরা যাই লালপুরের বেনারসি পল্লীতে। খবর পেয়েছিলাম রামকান্তপুর গ্রামের তাঁতিরা ভালো মানের বেনারসি শাড়ি তৈরি করছে। তখন দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভালো। মানুষের মনে কিছুটা স্বস্তি লক্ষ্য করা যায়। পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় গতি সঞ্চারিত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এটি স্বল্পস্থায়ী।
যাই হোক, একদিন সুন্দর এক সকালে আমরা মোটর সাইকেল নিয়ে চললাম বেনারসি পল্লীতে। গ্রামবাসী কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলো। তাদেরকে বিষয়টি জানালাম। ওরাও খুশি হয়ে ছবি তোলার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি প্রবীণদের মুখে শুনলাম পেছনে ফেলে আসা গল্প। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের বেনারসের প্রায় ৩৭০টি মুসলমান তাঁতি পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ব্যবসা শুরু করে। বৃহৎ অংশটি ছিল প্রায় ২০০ পরিবারের, যারা ঢাকার মিরপুরে বসতি স্থাপন করে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে স্থানীয়রা এ পেশায় ব্যাপকভাবে জড়িত হবার পরই বেনারসি শিল্পের অগ্রগতির সূচনা ঘটে। মাত্র বছর দশেক আগে এই গ্রামে শুরু হয় বেনারসি শাড়ি তৈরির কাজ।
লালপুরের শাহ্ আলম সেলিম ২০১৭ সালে জনকন্ঠে একটি খবরে উল্লেখ করেন, নাটোরের লালপুর উপজেলার ঐতিহ্য রামকান্তপুর গ্রামের বেনারসি পল্লীর তাঁতশিল্প বিলুপ্তির পথে। এক সময় খট খট শব্দে ও ক্রেতাদের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো এই বেনারসি পল্লী। এখন অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে জীবিকার জন্য অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন । প্রায় ২২ বছর পূর্বে গড়ে ওঠা এই বেনারসি পল্লীতে ৩৫টি পরিবারে শতাধিক তাঁতের মধ্যে এখন মাত্র ১টি তাঁতে তৈরি হচ্ছে শাড়ীর পরিবর্তে বেনারশি থ্রি-পিচ।
সামরিক সরকারের আমলে মার্কেটে শাড়ি বিক্রয়ে ধ্বস নামায়, নামমাত্র দামে সবাই তাঁত বিক্রি করে দেন। গ্রামের ইউনুস আলী বলেন, প্রায় ২০-২২ বছর পূর্বে পার্শ্ববর্তী ধানাইদহপাড়ার জাফর মৌলভী প্রথমে নিজের বাড়িতে তাঁত বসিয়ে শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় পরে পর্যায়ক্রমে এই বেনারশি পল্লী গড়ে ওঠে। অন্তত, ৩৫টি বাড়িতে শতাধিক তাঁতে সারা বছর শাড়ি তৈরী হতো। নিপুন হাতে তাদের প্রস্তুতকৃত বারকেট, নেট, জানিবাহার, টাইটনিক্সসহ নানা নামের আকর্ষণীয় ডিজাইনের শাড়ির কদর ছিল ঢাকাসহ সারাদেশে।