নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা মহামারী ও নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে সব ধরনের উদ্যোগ, যোগাযোগ ও আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রেখেছে মিয়ানমার। তবে এখন মিয়ানমারের নির্বাচন পর্ব শেষ এবং করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আনার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা। এখন দেশটির নবনির্বাচিত সরকারের কাছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর তাগিদ দেবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। মিয়ানমারে গত রবিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সহজ জয়লাভের পর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করতে চলেছে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। গতকাল মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, যদিও মিয়ানমারের।
নির্বাচনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, তবুও দেশটির নতুন সরকারকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে। তারা সরকার গঠনের পরপরই চীনের মধ্যস্থতায় সু চির উপস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দ্রুত আলোচনার আগ্রহও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরুর ইঙ্গিত দিয়ে ড. মোমেন বলেন, আমরা এ নিয়ে বরাবরই ইতিবাচক। এ মুহূর্তে বলতে চাই, আর দেরি নয়, দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করুন বেইজিং প্রস্তাবিত তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকটি হোক।
মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের আগস্টে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ফলে শুরু হয় চলতি শতাব্দীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট। এর পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। এ বিষয়ে দুবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও মিয়ানমারের অসহযোগিতা এবং রোহিঙ্গাদের অনাস্থায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। এমতাবস্থায় গত মাসের মাঝামাঝিতে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ঢাকা সফরে এসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে বেইজিংয়ে বৈঠক করার প্রস্তাব দেন। অবশ্য চীনের প্রস্তাবিত ওই বৈঠকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চিকে উপস্থিত করার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ মনে করে, রাখাইনে ফেরার প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থার ঘাটতি বা অবিশ্বাস রয়েছে। আর সু চি সরকারকেই তা দূর করতে হবে। এ জন্য সু চির উপস্থিতি ছাড়া কোনো আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার সম্প্রতি জানিয়েছে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন উপযোগী যেসব কাজ হয়েছে তা নিয়ে তারা একটি বুকলেট প্রকাশ করেছে। রাখাইনের সর্বশেষ অবস্থা জানাতে এ বুকলেট নাকি রোহিঙ্গাদের দেওয়া হবে। বাংলাদেশে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে বলে সম্প্রতি তারা চীনকেও আশ্বস্ত করেছে। কদিন আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই টেলিফোনে আলাপকালে মিয়ানমারের তরফে পাওয়া ওই আশ্বাসের বিষয়টি ঢাকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। সে দিনের আলাপে বেইজিং জানায়, প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ চলছে।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যতই আশাবাদী হোন না কেন, নেতৃত্বের পরিবর্তন না আসায় মিয়ানমারের নতুন সরকারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের আগের অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন করবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষকরা। বরং করোনাসহ বিভিন্ন অজুহাতে ইস্যুটি তারা ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ন কবীর বলেন, মিয়ানমার এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী হবে বলে মনে হয় না। তবে চীন যদি মধ্যস্থতা করে তা হলে হয়তো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আসতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানে জোর দিয়ে আসছে চীন। এরই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ডেকেছিল তারা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য ত্রিপক্ষীয় একটি কমিটিও হয়। কিন্তু কয়েকদফা বৈঠক হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি দিন ঠিক ছিল। কিন্তু রাখাইনে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরতে চায়নি। একই কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় দফার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।